করোনার থাবায় ক্ষতিরমুখে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

এবার মহামারি করোনাভাইরাসের থাবায় যেন লণ্ডভন্ড হতে চলেছে দেশের সীমান্তবর্তি জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। করোনার কারণে গতকাল আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়ে লকডাউন। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ‘আমের রাজ্য’ খ্যাত এ জেলাটি। জেলার সবচেয়ে বড় আমের বাজার বসে শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে। প্রতি আমের এই ভরা মৌসুমে বাজারটিতে আমের যেন মেলা বসে প্রতিদিন। সাইকেলে, ভুটভুটিতে বা মিনি ট্রাকে করে হাজার হাজার মানুষ সকাল থেকে আম নিয়ে ছুটে আসেন বাজারটিতে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় সরগরম হয়ে ওঠে কানসাট বাজার। কিন্তু এবার এসবের তেমন যেন লেশ নেই। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে এখনো ছুটে আসেনি কোনো ক্রেতা। নেই চিরচেনা কোলাহল। লকডাউনের কবলে পড়া কানসাট বাজারটিতে যেন খাঁ-খাঁ চারদিক। এই অবস্থা শেষ পর্যন্ত চলতে থাকলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়বেন চাষিরা। বলা যায়, এবার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা নিয়েও শঙ্কায় পড়বেন ব্যবসায়ীরা।

চাঁপাইনবাবেঞ্জে প্রথম সপ্তাহ কঠোর লকডাউন পার হয়েছে সোমবার। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায় আরও সাতদিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। আর এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আম ব্যবসায়ীরা এখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রবেশ করতে পারেনি। যদিও আম ব্যবসায়ীদের চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের করোনা রোগী সনাক্ত হওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে আতঙ্কে মূলত ক্রেতারা যেতে পারছেন না। আবার পর্যাপ্ত যানবাহনও পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে আম নিয়ে চরম একটা শঙ্কটই তৈরী হয়েছে এই জেলাটিতে।

সরজেমিন ঘুরে দেখা গেছে, শহরের প্রবেশপথগুলোয় পুলিশের কড়া তৎপরতা দেখা গেছে। শহরের দিকে আসা মোটরসাইকেলচালকদেরও পড়তে হচ্ছে পুলিশি জেরার মুখে। কিন্তু জরুরি কাজের জন্য হেঁটেই চলাচল করতে দেখা যায় মানুষকে। খাদ্যদ্রব্যের দোকান ছাড়া প্রায় সব দোকান ছিল বন্ধ। কাজের সন্ধানে বের হওয়া বা প্রয়োজনীয় কাজে বের হওয়ার মানুষদের ভিড় দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। ফলে আম নিয়ে তেমন কারও যেন মাথা-ব্যাথা নাই।


এমন পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি আমের ব্যবসায়ীরাও আসতে পারছে না। তাতে করে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কানসাটের আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা। ক্রেতা না পাওয়ার আশঙ্কায় অনেক গাছে আম পেকে গেলেও তা পাড়ছেন না চাষিরা। যদিও আরও কয়েকদিন পরে আমের পুরো মৌসুম শুরু হবে এই চাঁপাইনবাবগঞ্জে। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক গাছে গাছে আম পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু ক্রেতা না থাকায় সেসব আম তেমন বেচা-কেনা হচ্ছে না। যদিও কেউ কেউ মোবাইল ফোনে পাইকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাগান থেকেই সরাসরি আম সরবরাহ করছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু সেটির পরিমাণও তেমন বেশি নয়। কানসাট বাজারে যে পরিমাণ কেনাবেচা হয় স্বাভাবিক সময়ে তার চেয়ে খুবই পরিমাণে কম। এরই মধ্যে গতকাল হাতে গোনা কয়েক ভ্যান আম জড়ো হয়েছিল কানসাট বাজারে। সে আম বিক্রি করতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে আম চাষিদের।

এদিকে এবারও শিবগঞ্জ-সোনামসজিদ সড়কের কানসাট এলাকায় রাস্তার দুই ধারে বসেছে প্রায় ৩০০ আমের আড়ত। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত বেচা-কেনা শুরু হয়েছে মাত্র ছয়-সাতটিতে। এগুলোর মধ্যে গতকাল দুপুরে স্বর্ণা এন্টারপ্রাইজ আমের আড়তের সামনে মাত্র দুই ভ্যান আম দেখা গেছে গতকাল। প্রতিষ্ঠানের মালিক হাসান আলী বলেন, এ সময়ে গতবারও কমপক্ষে ২০ ভ্যান আম কিনতাম প্রতিদিন। কিন্তু এবছর দুই-তিন ভ্যানের বেশি জুটছে না। আমও বাজারে কম আসছে।

আরকে ব্যবসায়ী আশরাফুল বলেন, অন্যান্য বার এ সময় কানসাটের রাস্তার দুই ধারে আম বিক্রির জন্য বহু ভ্যান ও শত শত বাইসাইকেল দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু এবছর রাস্তা পুরোটা ফাঁকা থাকছে দিনের অধিকাংশ সময়। যেন শুনশান অবস্থা বিরাজ করছে।

এ বাজারের আম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ মঙ্গলবার থেকে হিমসাগর (ক্ষীরসাপাতি) আম বাজারজাত শুরু হবে। এখন গুটি জাতের ও গোপাল ভোগ জাতের আম বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য বছরে এ বাজার থেকে এই সময়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ থেকে ৮০ ট্রাক আম যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু এখন গড়ে ১০ থেকে ১৫ ট্রাক আম যাচ্ছে। কিন্তু এসব আমও বেশিরভাগই সংগ্রহ করা হচ্ছে সরাসরি বাগান থেকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব বড় ব্যবসায়ী আম কিনতে কানসাট বাজারে জড়ো হন, তারা লকডাউনের জন্য যেতে পারছেন না।

এজন্য বাজারে আমের কেনা-বেচা নাই বললেই চলে। আর এতেই শঙ্কা বাড়ছে চাষিদের মাঝে। উপজেলার শাহবাজপুর এলাকার আমচাষি আসাদুল আলম বলেন, এবারও সাড়ে চার বিঘা জমিতে আম বাগান রয়েছে। প্রায় সব গাছে ভালো আম ধরেছে। অন্যান্য বারে বাগান থেকেই আম বিক্রি হয়ে যেত বেশিরভাগ সময়। কিন্তু এবার যেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাইকাররাই নামেনি। ফলে বাগান থেকেও তেমন আম বিক্রি হচ্ছে না। আবার বাজারে নিয়ে গেলেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। আম নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।’

রানিবাজার এলাকার জমসেদ আলী বলেন, আমার প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে আমের বাগান রয়েছে। এসব আমের মধ্যে কিছু গুটি জাতের আম গাছে পেকেছে। বাজারে ক্রেতা না থাকায় সেগুলো বিক্রি করতে পারছি না আবার ভাঙতেও পারছি না। ফলে গাছেই পচে নষ্ট হচ্ছে এসব আম।’

কানসাট আম আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারু টিপু বলেন, প্রশাসন থেকে অনলাইনে আম বিক্রির কথা বললেও তা সম্ভব নয়। কেননা অনলাইনে সর্বোচ্চ পাঁচ ভাগ আম বিক্রি হয়ে থাকে। বাকি ৯৫ ভাগ আম কানসাট বাজার থেকেই বিক্রি হয়। কিন্তু বাজারে বাইরের বেপারিরা না এলে এ বাজার জমবে না। যদিও স্বাস্থ্যবিধি মেনে আবাসিক হোটেলে বাইরে থেকে আসা পাইকারদের থাকার জন্য ব্যবস্থা ও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও করোনা আতঙ্কে ও লকাডাউনের কারণে পাইকাররা আসছেন না। এটি চলতে থাকলে বড় ধরনের ক্ষতিরমুখে পড়বেন এ জেলার হাজার হাজার আমচাষি।’

ববি ট্রেডার্স নামের এক আম আড়তের মালিক মিজানুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত আমি কোনো আম কিনতে পারেনি। বাগানগুলো থেকে আম আসছে না। বাজারে বাইরের কোনো বেপারি নাই। আম ব্যবসার অবস্থা খুবই শোচনীয়। অন্যান্য বার এ সময়ে বাগানগুলো থেকে বিশেষ কায়দায় সাইকেলের দুই পাশে দুটি বড় ঝুড়িতে করে একেকজন শ্রমিক অন্তত পাঁচ মণ করে আম নিয়ে জড়ো হতেন কানসাট বাজারে। এমন হাজারো শ্রমিকে ভরে উঠতো বাজার। এরপর বিক্রেতা ও ক্রেতাদের পদচারণা তো ছিলই। এবার যেন কিছুই চোখে পড়ছে না। চোখ বুজলেই যেন স্মৃতিগুলো ভাসছে শুধু।’

এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, আম কেনাবেচার জন্য প্রশাসন সব সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। যদি কোনো ব্যবসায়ী মনে করে তাদের পরিচয়পত্র দরকার আছে সেটিও কৃষি বিভাগ দিতে প্রস্তুত রয়েছে। অনলাইনের পাশাপাশি জেলার প্রধান আম বাজারগুলো যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে সে নির্দেশনা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া দ্বিতীয়বার ঘোষিত লকডাউনে আম ব্যবসায়ীরা যেন অবাধে আম কেনাবেচা করতে পারে সেটিরও ব্যভস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও তেমন ক্রেতা আসছে না বলে শুনেছি। এটি হয়তো দ্রুত কেটে যাবে। মানুষের মাঝে যে আতঙ্ক আছে, সেটি কেটে গেলেই ব্যবসায়ীরাও আসতে শুরু করবেন। তখন বাজারও জমবে। আবার বাগান থেকেও আম কেনাবেচা হবে প্রচুর।’

স/আর