একা হওয়ার স্থাপত্য

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আজ আর সে যুগ নেই যে সঙ্গী বা আত্মীয়বিহনে কেউ একা হয়ে গেল। আশ্চর্য! শপিং মলের এসকালেটরে যারা চলমান অশরীরী, তারা জানেও না শূন্যতার বাহুডোর ক্রমেই ভিড়ের হৃদয় থেকে তাদের জন্য আলোকিত নিঃসঙ্গতা নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। মহেঞ্জোদরো থেকে যারা সিন্ধুনদের গমনপথের দিকে তাকিয়েছিল, যারা অতীশ দীপঙ্করের মতো তারা ভরা রাতে সন্ন্যাসী একা যাত্রী, তারা কি এই ভবিতব্য চেয়েছিল?

বৃহদারণ্যক উপনিষদ জানিয়েছিল, একদা এই ‘একা থাকার উদ্ধার মন্ত্র’, ‘তিনি ভয় পেলেন, সেই জন্য লোকে একাকী থাকতে ভীত হয়। সেই বিরাট চিম্তা করলেন- যেহেতু আমার থেকে ভিন্ন কেউ নেই, তখন কার কাছ থেকে ভয় পাচ্ছি?’ আমাদের সেই জ্ঞানের দীপ্তি নেই। আমরা তো জানি না, পূর্ব কলকাতার প্রশস্ত উপনিবেশে যে সব আকাশচুম্বন সেখানে হলুদ আলোর পাশে, কালো সার্সির আড়ালে আর কেউ আছে কি নেই। ‘আমাদের নৈশসড়ক’ দুপুরের কাকগোঙানির বার্তা বয়ে আনে। ফাঁকা রাস্তায়, বাসস্টপে যুবতী অপেক্ষা করে, ত্রস্ত এবং একা, গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকে যুবক, একা ও ক্লান্ত। শহরজুড়ে একা হওয়ার রূপকথা মাকড়শার জালের মতো বাহু বিস্তার করে। পথের মোড়ে হোর্ডিং— একা ওষ্ঠ, একা শ্রোণীযুগ।

যারা ভোট দিয়ে মিশে গেছি জনমতামতে, গ্রন্থকে বিশ্বাস করে পড়ে গেছি, সেই আমাদের হাতে এমন কোনও আমলকি নেই যাতে যূথবদ্ধ হওয়ার আশ্বাস। চারিদিকে সফলতার হাতছানি, রণক্লান্ত শীর্ষারোহণ কী ভয়াবহ আজ কলকাতায় থেকেও আমরা বুঝি। শৃঙ্গজয়ের পর দূর উপত্যকাতেও কোনও মানুষ দেখা যায় না, নারী ও নিসর্গ বিজ্ঞাপন চিত্রের মতো আরোপিত মনে হয়। এই কি আমাদের মহাপ্রস্থান যাত্রা?

এই তো সে দিন, এক পলিতকেশ বৃদ্ধ তাঁর সহধর্মিণীকে ঈশ্বরের হাতে রেখে এসে নিজেও শবযাত্রার অনুগমন করলেন ‘শব’ হয়ে। তা হলে এই প্রাচ্য দেশে এখনও হয়ত দীর্ঘ করবন্ধনের কোনও মানে রয়ে গেল! কিন্তু থাকবে কি আর প্রলয় যাত্রায়? পৃথিবী সোনার দোকান খুলে রেখেছে আর আমরা পৌরাণিক রাজা মিডাসের মতো নামহীন ত্রাসে— নিজেদের অনুভূতিহীন জড় পাথরের টুকরোতে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। আমাদের লিপ্সা আছে, লিপ্তি নেই। নির্বাচিত ভিড়ে উগ্র উচ্চাশার গন্ধ কেবলই ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র শরীরে। মনে পড়ে সুইডিশ ছায়াছবির অদ্বিতীয় ঈশ্বর ইংগমার বার্গম্যানের ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭)। কী অসামান্য ভাবেই না তিনি দেখিয়েছেন প্রতিষ্ঠার কঙ্কাল! সাফল্যের চূড়ান্ত লগ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক উপাধি গ্রহণের প্রাক্কালে বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক আইজ্যাক বর্গ উপলব্ধি করলেন, হৃদয় যখন শুকায়ে যায় তখন করুণাধারায় কাউকে আহ্বান করার যোগ্যতা পর্যন্ত তার নেই। বস্তুর সাম্রাজ্যে, নিরাকার বাসনায় স্বামী, প্রেমিক, পিতা, এমনকী বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি এক নির্জন বাসিন্দা, সমস্ত পরীক্ষা তাঁকে পরাস্ত করে। প্রশ্নের জবাবে তিনি বিমূঢ়। অবশেষে তিনি জানতে চান, হোয়াট ইজ দ্য পেনাল্টি? উত্তর পান, ‘দ্য ইউজুয়াল ওয়ান, আই সাপোজ, লোনলিনেস।’

আত্মসর্বস্বতায় যে দেশকাল পটভূমিতে সংবেদনা অসাড় হয়ে গিয়েছে, আত্মা যেখানে ফ্রিজে রাখা মাংসের টুকরো, সেখানে বৃদ্ধবর্গের আত্মজ্ঞানার্জন কোনও বোধিপ্রাপ্তি নয়, বরং বাধ্যতামূলক স্বীকারোক্তি। যদিও শিখরে আরোহণের মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়েছে নরকমন্থন, তবুও ‘বুনো স্ট্রবেরি’ কোনও মহিমান্বিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নয়, ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধ যেমন। মানবপুত্র অধ্যাপকবর্গ যতটা নশ্বর ও হতবুদ্ধি ততটা প্রজ্ঞানময় ও সম্ভ্রান্ত নয়।

তবে ‘একাকিত্ব’ নামের অনুভূতি পরিসর যাঁর চিন্তায় উল্কির মতো দাগ রেখে যায় তিনি ইতালীয় চলচ্চিত্রকার আন্তোনিওনি। আধুনিকতার প্রথম পথিক বোদলেয়ার যে অনুভূতিহীনতাকে ‘অনুই’ নামে বিখ্যাত করেছেন, চলচ্চিত্র ভাষায় সেই ঐতিহ্যের সৌজন্যে চলচ্চিত্রবেত্তারা ‘আন্তোনিয়েনুই’ শব্দটি আবিষ্কার করেন। আমরা কি জানতাম সমুদ্রে শূন্যতা আছে- তাতে পরাগ সঞ্চার করা যায়? ‘লাভেঞ্চুরা’ ছবিটি আমাদের মর্মে সিলমোহর দিয়ে দিল। শূন্যতাকে মনে হল নক্ষত্রনারী কেশপাশ। অভিনেত্রী মনিকা ভিত্তির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার সময় আমরা বুঝতে পারি না কী অসমসাহসে আন্তোনিওনি রতিশয্যায় পাঁচিল তুলে দিতে পারেন। সেখানে সিন্ধু রূপসীর কটিদেশ গোঙায়, শহর যেখানে লাল মরুভূমি, সেই অলীক জনপদে, দৃশ্যের পর দৃশ্যে, একা হতে হতে আমরা টের পাই নিয়তি বস্তুত কবরখানার রতিমুদ্রা।

আন্তোনিওনির নিঃসঙ্গতা আজ নব-নাগরিক কলকাতায় কত বাস্তব। ‘স্কাই-ওয়াক’ সমূহে কংক্রিটের শিত্কার, এক প্রবাসী প্রৌঢ়ের মুখে মৌনতার স্তব্ধনীল ফ্রেম। আজ রাতের শিরা উপশিরায়, সাইবার স্পেসে মানুষের বিস্মিত হওয়ার চিহ্ন প্রায় নেই। প্রতি মুহূর্তে সে কথা বলে- ডিজিটাল দুনিয়ায় সকলেই শুধু ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে বা টুইটারে। কিন্তু যা অজ্ঞেয়, যা নৈতিক, যাকে কথায় ও মনের গহনে আঁকা যায় না, যা অপরিচয়ের তা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। স্টক এক্সচেঞ্জের বিধুর বিকেলে আর কাউকে ছায়ানারী মনে হয় না। এত দৃশ্যের কুচকাওয়াজ, এত কর্কশ ক্যাকোফোনি যে আমরা নির্জন হতে ভুলে যাই।

ঈশ্বর পরিত্যক্ত এই জনারণ্যে তাই প্রত্যেকেই নিরালম্ব, বায়ুভূত, নিঃসঙ্গ কবন্ধের সমাবেশ। বস্তুকামে, গৃধ্নুতায়, ইতালিয়ান টালিতে আমাদের পায়ের চিহ্ন পড়ে না। প্রেতের কোনও স্বগোত্র থাকে না।

অথচ একা মানুষ কত সুন্দর হতে পারে। ধরা যাক সিনেমার একটি মুহূর্ত। ক্যামেরা থেকে তার দূরত্ব অনেক, ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’য় সে বসে আছে, ঈষত্ পরিপ্রেক্ষিতহীন, ঈষত্ গ্রন্থিচ্যুত— আলো ক্রমে আসিতেছে। এই যে আকুল তরুণী-রবীন্দ্রনাথের একাকিনী যেন- সপ্তাশ্ব রথ কি তার জন্য প্রস্তুত: মর্ত্যের সীতা থেকে সে স্বর্গে উত্তীর্ণ হবে। তার ভোর হয়েছে, তাই অন্তরীক্ষে সে রেখে দিল এক বিন্দু বিষাদ। যে তার সকল নিয়ে বসে আছে সর্বনাশের আশায়, সে আমাদের কাছে চকিতে মীরাবাঈ হয়ে বাস্তব ও রূপকথার অন্তর্বর্তী স্তরে নক্ষত্র হয়ে ফুটে উঠল।

নিঃসঙ্গতা আসলে পারাপারহীন এক টুকরো পূরবী, তা সময়সমুদ্রের শব্দহীন উপাখ্যান, তা শূন্যতার ধূ ধূ পল্লি- শেফালিকা কুঞ্জ। যেন রামকিঙ্করের রবীন্দ্রনাথ। যেন রেমব্রান্টের ঐতিহাসিক শেষ আত্মপ্রতিকৃতি। শপিং মলের সভ্যতা তা বোঝে না। সে মৃত্যু সংবাদকে ভাবে কলমের গোঙানি।

অানন্দবাজার