এই সময়ে শিশুর ডেঙ্গু

মশাবাহিত জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত রোগ ডেঙ্গু। বেশির ভাগ ডেঙ্গু হয়ে থাকে অনূর্ধ্ব ১৫ বছর বয়সে। সংক্রমণের উচ্চহার লক্ষ করা যায় বর্ষাকালে এবং শহর ও শহরতলির ঘিঞ্জি এলাকার জনগোষ্ঠীতে।

ধরন চারটি
ডেঙ্গু ভাইরাস এক সূত্রক বিশিষ্ট আরএনএ ভাইরাস, যা ফ্ল্যাভিভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভাগ বা সেরোটাইপ শনাক্ত হয়েছে, যেগুলো রোগের পূর্ণচিত্র তৈরিতে সক্ষম। এগুলোর নাম হলো—ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩, ডেন-৪। শিশু যে ধরনের টাইপ দ্বারা আক্রান্ত হবে, সেরে ওঠার পর সেই টাইপের ভাইরাসের বিরুদ্ধে জীবনব্যাপী এবং অন্যান্য টাইপের বিরুদ্ধে কেবল সাময়িক রোগ প্রতিরোধী শক্তি লাভ করে। তাই একবার এক টাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা কেউ আক্রান্ত হলে তার অন্যবার অন্য টাইপ দ্বারা আবারও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একসঙ্গে একাধিক টাইপে আক্রান্ত হলে অথবা দ্বিতীয়বার আক্রান্তের ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা থাকে অনেক বেশি।

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা। কয়েক প্রজাতির স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক, যার মধ্যে এডিস ইজিপ্টি প্রধান। এডিস মশার শরীরে ডোরাকাটা দাগ থাকে বলে এর অন্য নাম টাইগার মশা। এই মশা চার থেকে পাঁচ দিনের স্বচ্ছ জমানো পানিতে দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটায় এবং কৃত্রিম জলাধারে ডিম পাড়তে, মানুষকে কামড়াতে ও রক্তপান করতে বেশি পছন্দ করে। এডিস মশা মূলত কামড়ায় দিনের বেলায়, বিশেষত সূর্যোদয়ের কয়েক ঘণ্টা পরে এবং সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক আগে।

উপসর্গ
ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সাধারণত ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ দেখা যায়। এসব উপসর্গ দুই থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এটা তিন পর্বে হয়ে থাকে—

এক থেকে পাঁচ দিন : হঠাৎ তীব্র জ্বর, প্রায় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত উঠতে পারে। সঙ্গে হাড়ের জোড়া, মাংশপেশি, চোখের পেছনে ও মাথায় প্রবল ব্যথা, বমি বমি ভাব থাকে। বর্ষাকালে কোনো শিশু যদি পাঁচ-ছয় দিন বেশি মাত্রার জ্বর নিয়ে আসে তাহলে তা ডেঙ্গু কি না যাচাই করা দরকার। এই সময়ে শিশুর জ্বর কমাতে অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন দেওয়া মোটেই উচিত নয়।

পাঁচ-সাত দিন : এটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের সময়কাল। কয়েক দিন জ্বরে ভোগা শিশুতে অত্যধিক ক্লান্তি, পেট ফাঁপা-ফোলা, খিদে লোপ, মুখ-হাত-পায়ের পাতায় লালচে ভাব দেখা যায়। প্রস্রাব কমে যাওয়া, নাক ও মাড়ি থেকে রক্তপাত, নারীর অতিরিক্ত রক্তস্রাব দেখা দিতে পারে।

এই সময় শরীরের তাপমাত্রা কম থাকলেও শিশুর উন্নতি হচ্ছে বলে ভুল বার্তা সৃষ্টি করে। কিন্তু এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নাড়ি দুর্বল ও দ্রুত হওয়া, রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে গিয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের এসব লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হতে থাকে।

সুস্থতা পর্ব : আরো ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা কেটে গেলে শিশুর আর জ্বর থাকে না। শক সিনড্রোম হওয়া থেকে সে রেহাই পেয়েছে বলা যায়। এই সময় নাড়ির গতি, রক্তচাপ, প্রস্রাব স্বাভাবিক থাকে, রুচি বাড়ে, শরীরের বল ফিরে আসে, পেট   ফাঁপা-ব্যথা কম। তবে হাত ও পায়ের তালুর চুলকানো রেশ বহাল থাকতে পারে।

পরীক্ষা
প্রথম সাত দিনে পিসিআর, ভাইরাল অ্যান্টিজেন পরীক্ষার রিপোর্ট প্রায় নির্ভুল। অসুখের পাঁচ-সাত দিন পর থেকে আইজি অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয় এবং উপসর্গসহ সেরোলজি টেস্টে এই অ্যান্টিবডির শনাক্তকরণ রোগ নিরূপক। রক্তের হিমাটোক্রিট, রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা, প্রয়োজনে বুকে ও পেটে পানি জমা নির্ণয়ে যথাক্রমে বুকের এক্স-রে ও পেটের আলট্রাসাউন্ড ইত্যাদি পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে।

চিকিৎসা
ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট ওষুধ বা চিকিৎসা নেই। সাধারণ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে জ্বর লাঘবে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিতে হবে। পাশাপাশি পরিপূর্ণ বিশ্রাম ও বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় পান করানো প্রয়োজন। আর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের উপসর্গ দেখা দিলে শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

প্রতিরোধে করণীয়
শিশুর ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো মশার কামড় থেকে সুরক্ষা দেওয়া। এ জন্য কিছু করণীয় হলো :

* মশার আবাসস্থল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করা। ঘরের আশপাশে ফুলের টব, ডাবের খোসা, ক্যান, গাড়ির টায়ার, এয়ারকুলার, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি যেন জমা না থাকে সে রকম ব্যবস্থা অবলম্বন করা। মশা বৃদ্ধির স্থানে কীটনাশক ও ঘরে মশা তাড়ানোর রিপেলেন্টস ব্যবহার করা।

* ঘরের বাইরে বেরোলে মশার কামড় এড়াতে শিশুকে ফুল শার্ট, ফুল প্যান্ট ও মোজা পরানো উচিত, যাতে তার হাত-পা ঢাকা থাকে।

* দিনের বেলায়ও মশারি খাটিয়ে শিশুকে ঘুম পাড়ান।

* পরিবারে কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে, শিশু ও অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য মশারির ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড়িয়ে মশা আবার সুস্থ কাউকে না কামড়াতে পারে।  তবে ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ নয়।

* জটিলতা দেখার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কেননা শিশুর বেশির ভাগ ডেঙ্গু উপসর্গহীন থাকে। অথবা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশিতে ভুগে কয়েক দিনের মধ্যে আপনাআপনিই সেরে যায়। তবে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। শিশু ও অল্পবয়সীদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি। ডায়াবেটিস ও অ্যাজমার মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগা শিশুদের ডেঙ্গু অনেক বেশি প্রাণঘাতী।

এসব কারণে করোনার অতিমারির এই সময়ে শিশুর জ্বর হলে অযথা সময়ক্ষেপণ না করে নিকটস্থ হাসপাতাল কিংবা শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা গ্রহণ করুন।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ