এই লড়াইয়ে জিততে হবে

বৃহস্পতিবার ঢাকা শহরের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ৯টি (মতান্তরে ১০টি) যাত্রীবাহী পাবলিক বাসে কে বা কারা অগ্নিসংযোগ করে তা আংশিক বা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করেছে। প্রথম বাসটিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল দুপুর ১২টার কিছু পর ঢাকার নয়াপল্টনের বিএনপি কার্যালয়ের সামনে আর তা ছিল রাস্তার ওপর রাখা একটি সরকারি খালি বাস। যখন বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়, তখন বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে দলের সভা চলছিল। এর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে আরো আটটি বাসে একই কায়দায় অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং এর বেশ কয়েকটিতেই যাত্রী বোঝাই ছিল। ভাগ্য ভালো, এ ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়নি। যখন দুর্বৃত্তরা এই ঘটনা ঘটাতে লিপ্ত ছিল, তখন ঢাকা-১৮ নির্বাচনী এলাকায় উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। এই নির্বাচনের আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে তাঁরা সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবেন। অবশ্য বিএনপি ও তাদের মিত্র ওয়ানম্যান পার্টির নেতারা নিয়মিত বিরতি দিয়ে এই ধরনের হুংকার ছাড়েন। ঢাকার যে আসনে উপনির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলো তাতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয় পেলেন। আসনটি শূন্য হয়েছিল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সাহারা খাতুনের মৃত্যুজনিত কারণে। রাতে একাধিক বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বিএনপি নেতা নিতাই চন্দ্র রায় আর জনৈক ইয়াসমিনের একটি অডিও ক্লিপ প্রচারিত হলো, যাতে দেখা গেল বিএনপি অফিসের সামনে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনার জন্য ইয়াসমিন যুবদলের সদস্যদের শনাক্ত করছেন। এই অডিও ক্লিপের সত্যতা যাচাই করার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এত দূর পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কারণ বিএনপি ও তাদের নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের ২০১৩-১৫ সালের অগ্নিসন্ত্রাসের কথা মানুষ ভুলে যায়নি। সেই সন্ত্রাসে দেশে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় শ নিরীহ ছাপোষা দিন আনে দিন খায় মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল আর দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতের কয়েক শ কোটি টাকার জনসম্পদ ধ্বংস হয়েছিল।

পরের প্রশ্ন, বাকি যেসব স্থানে বাসে অগ্নিসংযোগ করা হলো, তা কি সবই বিএনপির সন্ত্রাসীরা করেছে? এর উত্তর খুঁজে পাওয়া না গেলে ধরে নিতে হবে, সম্ভবত আরেকটি অগ্নিসন্ত্রাস যুগের সূচনা হলো গত বৃহস্পতিবার, যার একমাত্র উদ্দেশ্য বর্তমান সরকারের ঈর্ষণীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করা আর সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। প্রশ্ন—কারা এই নতুন অগ্নিসন্ত্রাস যুগের সূচনা করল? এই কাজ বর্তমানে ছত্রভঙ্গ বিএনপির একার পক্ষে করা সম্ভব নয় বলে ধারণা করা হয়। অতীতেও দেখা গেছে, তাদের এই মানুষ মারার কর্মসূচির মূল সৈনিক ছিল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। তারা এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। একসময় তাদের মানুষের রগ কাটার প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো। বিএনপি এখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে পারে; কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের শক্তি শুধু যে অটুট আছে তা-ই নয়; তারা আরো নানাভাবে শক্তিশালী হয়েছে। তাদের চলার পথের সঙ্গী হয়েছে জেএমবি, নব্য জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর, জামায়াতের নতুন সংস্করণ ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ বা এবি পার্টি। এবি পার্টির আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক আমলা, ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় ফেনীর ডিসি এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী। একসময় যখন আলহাজ এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র ছিলেন, তখন এই সোলায়মান চৌধুরী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। তখন খালেদা জিয়া ক্ষমতায়। ফেনীর ডিসি থাকাকালে তিনি ফেনীকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগমুক্ত করেছিলেন। মানুষ বলত, ফেনীতে সোলায়মানি আমল চালু হয়েছে। আর মুজিবুর রহমান মঞ্জু হচ্ছেন এই দলের সদস্যসচিব। চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্র থাকাকালে ছাত্রশিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার ও দলের সভাপতি। তাঁর পুরো পরিবার আবার আওয়ামী লীগ ঘরানার বলে জানা গেছে। সম্প্রতি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার নামে শাহবাগ এলাকায় একদল শিক্ষার্থী আন্দোলনের নামে শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করে মুজিব কোট পোড়ানোর যে আয়োজন করেছিল, তাতেও এই তথাকথিত এবি দলের নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন। হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের ১৩ মে ঢাকার শাপলা চত্বর দখলে নিয়ে পরের দিন সরকার গঠনের স্বপ্নে বিভোর ছিল। তাদের সার্বিক সহায়তা দিয়েছিল বিএনপি আর জামায়াত। সেদিন হেফাজত সারা দিন ও মাঝরাত পর্যন্ত ঢাকার কেন্দ্রস্থলে এক ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছিল। সরকারের দৃঢ় মনোভাব ও ব্যবস্থার কারণে সেই যাত্রায় তারা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। পরবর্তীকালে কৌশল হিসেবে সরকার হেফাজতকে বিএনপি-জামায়াত থেকে আলাদা করার জন্য নানা ধরনের ছাড়ও দিয়েছিল। তাতে সরকার অনেকখানি সফল হয়তো হয়েছে; কিন্তু কিছুদিন আগে আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজত এখন জামায়াতের সঙ্গে একীভূত হতে প্রস্তুত। সুতরাং বৃহস্পতিবার বাসে অগ্নিসংযোগের জন্য শুধু বিএনপির দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করলে তদন্ত কর্মকর্তারা বিভ্রান্ত হতে পারেন।

বর্তমানে সরকারের বিরুদ্ধবাদীরা অনেক বেশি শক্তিশালী ও জোটবদ্ধ। কারণ তারা হিসাব করে দেখেছে, সরকারের অনেক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও গত ১৪ বছরে দেশে যা উন্নতি হয়েছে, তা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় চোখ-ধাঁধানো। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের একটি রোল মডেল। দুর্নীতিটাকে আরো একটু লাগাম টানা সম্ভব হলে এই উন্নতি আরো অনেক দূর যেতে পারত। এর সঙ্গে সরকারের ভেতরে যোগ হয়েছে অনেক আওয়ামী লীগ লেবাসধারী জামায়াত-বিএনপির মানুষ, যারা সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারে সহজে। মাঝেমধ্যে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে কিছু পদায়ন দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এসএসএফের মহাপরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা, তাঁর অবসরের পর নিয়মিত নিউ ইয়র্কভিত্তিক একটি ফেসবুককেন্দ্রিক টক শোতে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী বিরোধী কথাবার্তা বলেন, বিষোদগার করেন। চিন্তা করি এ-ও কি সম্ভব? কিছুদিন আগে সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুর হাতে করা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অমুকজনকে কিভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হলো। তাঁকে আইনের কপিও দেখালাম। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, ‘তাহলে কি ভুল হয়ে গেল।’ বলি, না, ভুল হয়নি। যাঁরা এই কাজ করেছেন, তাঁরা জেনে-বুঝেই করেছেন। সময়মতো আরো এমন কিছু ঘটনা হয়তো পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করব। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন ও প্যারিসে একাধিক সাংবাদিক ও পেশাজীবী নিয়মিত সরকারবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সব কিছু দেখা তো সম্ভব না। তাঁর অগোচরেই কত অপকর্ম যে ঘটে যায়, তা তিনি বুঝতে পারেন না। গত কয়েক মাস তাঁর চেহারা দেখলে বোঝা যায়, তিনি কত চাপের মধ্যে কাজ করেন।

অনেকে হিযবুত তাহ্রীরকে তেমন একটি গুরুত্ব দিতে নারাজ। কিন্তু তাঁরা হয়তো জানেন না, এই সংগঠনটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের প্রত্যেক সদস্য শিক্ষিত। প্রায়ই ধানমণ্ডি, শ্যামলী এলাকায় তাদের রঙিন পোস্টার দেখা যায়। শুক্রবার বেশ চালাকি করে তারা বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিদের মাঝে লিফলেট ছড়ায়, সরকার উত্খাতের ডাক দেয়। এরই মধ্যে তারা নাকি জুমে তাদের কাউন্সিল অধিবেশন করেছে। তাদের এই দেশীয় আমির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন।

বৃহস্পতিবার বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে ঢাকা দক্ষিণে। ক্যাসিনোকাণ্ড, হাজি সেলিম ও তাঁর গুণধর পূত্রের কর্মকাণ্ডসহ এমন আরো অনেক কর্মকাণ্ড ঢাকা দক্ষিণে ঘটেছে। যাঁরাই এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই হাইব্রিড আওয়ামী লীগার। দল করা তাঁদের নিজ স্বার্থ উদ্ধারের একটি অসিলা মাত্র। নিজের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য তাঁরা করতে পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। বৃহস্পতিবারের ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াতের ওপর অবশ্যই দৃষ্টি থাকবে, তবে অন্যদেরও দৃষ্টির মধ্যে না রাখলে তদন্ত কর্মকর্তারা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যেতে পারেন; আর এই ফাঁকে আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে। বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিয়ে নানাজনের নানা তত্ত্ব আছে। তবে সবচেয়ে চমৎকার তত্ত্ব দিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বাইডেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বাস পোড়ানো হয়েছে।’ তিনি আরো জেনেছেন, জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর নাকি সবাইকে ফোন দিয়েছেন; কিন্তু শেখ হাসিনাকে ফোন দেননি। জো বাইডেনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই শেখ হাসিনার নির্দেশে এই বাস পোড়ানো হয়েছে, যাতে বাইডেন সাহেব তাঁকে একটা ফোন দেন। যে যাই বলুক, এই করোনাকালে যখন মাসের পর মাস স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি, তখন ডা. জাফরুল্লাহর নিয়মিত ‘বুদ্ধিদীপ্ত বচন’ কিছুটা হলেও রিলিফের কাজ করে। তাঁর কথায় মনে পড়ল শীতকাল আসন্ন। সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে।

সব শেষে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একেবারে প্রথম দিন থেকে যে কজন মানুষ কাজ করতেন, তাঁদের একজনের কথা বলি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর অনেক কষ্টে তিনি দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। বেশ কিছুদিন তাঁর সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। একটু চাপা স্বভাবের মানুষ; কিন্তু আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কাজ করার কিছু অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতেন, যার সব কিছু হয়তো আমি কখনো অন্যকে বলতে পারব না। তিনি একদিন স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলেন। স্বপ্নে তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কেন এমন হলো?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন, ‘আমি স্বজনদের কথা সব সময় ফেলতে পারিনি আর কাছের মানুষগুলোকে বেশি বিশ্বাস করেছি।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা এই লেখাটা পড়বেন, সেই বিশ্বাসে এই কথাগুলো লিখলাম। আর বৃহস্পতিবারের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি পরিকল্পিত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত। এখন থেকেই সাবধান না হলে সামনের দিনগুলো আরো কঠিন হতে পারে। লড়াই যত কঠিনই হোক, সেই লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত সৈনিকদের জিততেই হবে।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ