চিকিৎসার নামে নির্যাতন ও আমাদের মূল্যবোধ

রাজধানী ঢাকার আদাবরে একটি মানসিক হাসপাতালে (মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র) একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। এসংক্রান্ত একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। নানা মহলে এ নিয়ে চলছে সমালোচনা ও পর্যালোচনা। সোমবার সকালে ভর্তির পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যান সেই পুলিশ কর্মকর্তা। পরিবারের অভিযোগ, ভর্তির পর পর হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। এ বিষয়ে পুলিশ ও পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা হয়েছে এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। হয়তো বা পুরো বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে জনসমক্ষে আসবে।

জানা যায়, জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। এমন একজন মেধাবী পুলিশ অফিসারকে হত্যার অভিযোগ নিঃসন্দেহে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মনুষ্যত্ববোধ ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ভয়াবহতা প্রমাণ করে। পরিচয় পাওয়ার পর এভাবে একজন পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে চিকিৎসা বা নিয়ন্ত্রণের নামে বর্বরতা আমাদের শঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও মানসিক চিকিৎসার হাসপাতাল পরিচালনার জন্য যেসব লাইসেন্স দরকার হয় তার কোনোটিই হাসপাতালটির নেই বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। ভিডিও ফুটেজে যাঁরা আনিসুল করিমকে টেনেহিঁচড়ে ওই বিশেষ কামরাটিতে নিয়ে যান, তাঁরা কেউই চিকিৎসক ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে চারজন ওয়ার্ড বয়, দুজন সমন্বয়কারী, আর কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন বলে পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, সেখানে সবাই মিলে আনিসুল করিমকে উপুড় করে ফেলে চেপে ধরে রেখেছে। কেউ আঘাত করছে। একপর্যায়ে আনিসুল করিমের মুখে পানি ছিটাতে দেখা যায়। পরে সাদা রঙের অ্যাপ্রন পরা এক নারী কক্ষে প্রবেশ করেন এবং মিডিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী সেখানে আনিসুল করিমের রক্তচাপ পরীক্ষা করা হয় এবং বুকে চেপে সিপিআর দিতে দেখা যায়। কিন্তু তাতেও সাড়া দেননি তিনি। তাহলে কি তিনি সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন?

ভর্তি করানোর সময় আনিসুল করিম যদি অস্বাভাবিক বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না করে থাকেন, তাহলে ওভাবে হাত-পা বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় বিশেষ রুমে নিয়ে যাওয়ার কী কারণ তা খুঁজে বের করা উচিত। যদিও হাসপাতাল (মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র) কর্তৃপক্ষ বলছে, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় তাঁরা পুলিশ কর্মকর্তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং নিজেকে ও অন্যকে যাতে আঘাত করতে না পারেন তার জন্য ওই কক্ষে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়ার সময় অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। কিন্তু একজন মানসিক রোগীকে এই বর্বর পন্থায় ধরে নিয়ে মারধর করে জোরপূর্বক শুইয়ে দেওয়ার যে চিত্র ভিডিওতে দেখা গেছে তা হিউম্যান এথিকস বা মেডিক্যাল এথিকস এবং ট্রিটমেন্ট প্রটোকলের মধ্যে পড়ে কি না তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।

মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় এবং ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় তিনি শান্ত ছিলেন বলে খবরে প্রকাশিত হয়। হঠাৎ এমন কী ঘটল যে তার আচরণ অস্বাভাবিক ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেল, কোনো কিছু না বলে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর শুরু করলেন পুলিশ অফিসার—এমন অভিযোগের কতটুকু ভিত্তি আছে? এমন কী কায়দায় তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন যে তারা রোগীকে একবারেই চিরদিনের জন্য নিস্তেজ করে দিলেন। যাঁরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন তাঁরা কি আদৌ মানসিক রোগী নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, নাকি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এসব প্রশ্ন থেকেই যায়।

বলা যায়, এসব কর্মচারী-কর্মকর্তা নামের সন্ত্রাসী পুষে থাকে অনেক হাসপাতাল। তাদের হয়তো বা এসব নির্দেশনা দেওয়া থাকতে পারে। এভাবে তারা অভ্যস্ত। এটাই হয়তো তাদের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। হয়তো বা এসব কাজ তারা প্রতিনিয়ত এভাবে করায় এবং কোনো বাধার বা জোরালো প্রতিবাদের সম্মুখীন না হওয়ায়, মিডিয়ায় প্রকাশ না পাওয়ায়, ভিডিও ভাইরাল না হওয়ায়—কে সাধারণ মানুষ, আর কে বিশেষ শ্রেণির মানুষ তাদের মাথায় কাজ করে না। আর তাদের নিষ্ঠুর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির জাঁতাকলে পড়ে দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকের মতোই জীবন দিতে হলো সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে।

আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে অনেক দক্ষ অফিসার আছেন, যাঁরা নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অনেক মেধাবী এখন এসব পেশায় এসে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যাঁদের অবদানে দেশে জঙ্গি দমন, যেকোনো জটিল পরিস্থিতিতেও অপরাধীকে ধরা, করোনায় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বিচক্ষণতার সঙ্গে করে যাচ্ছেন, তার নিদর্শন আমরা অনেক দেখেছি ও দেখছি। তাঁদের সীমাবদ্ধতা আছে এ কথাটি যেমন সত্য, তেমনি কিছু পুলিশ সদস্যের অপকর্মে তাঁদের অনেক ভালো কাজ ঢাকা পড়ে যায়। এই বাহিনীর একজন মেধাবী অফিসারকে চিকিৎসাব্যবস্থার নামে মেরে ফেলা জাতির জন্য নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত।

দেখা গেছে, বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী কোনো মাধ্যমে বা সুপারিশে অথবা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে না গিয়ে সাধারণভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসার জন্য গেলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে অনেক হাসপাতালে। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় এটি করা প্রয়োজন, যদি কারো সুযোগ থাকে। পুলিশ কর্মকর্তার পরিবার এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা আগে থেকে নিলে হয়তো ভালো হতো।

মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক অবক্ষয় ও বিচারব্যবস্থায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে দেশে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অনেকেই মনে করেন। সমাজের অসুস্থ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, অর্থ ও ক্ষমতার সঙ্গে মানুষের অবস্থানের মূল্যায়ন দেশ ও জাতিকে এক অজানা গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। খোঁজ নিলে এ রকম হয়তো অনেক কথিত সেবাকেন্দ্র পাওয়া যাবে, যারা অর্থের জন্য এসব অনৈতিক ও বর্বর কাজ করছে, যা অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় দেখা যায়। অনেক হাসপাতাল বা রিহ্যাব সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়ার নামে মারধর করা হয়। তাদের কোনো স্পেশালিস্ট ডাক্তার থাকে না। এসব রিহ্যাব সেন্টারে সরকারের নজরদারি করা উচিত।

এসব নিষ্ঠুর নির্যাতনের ঘটনা বিভিন্ন রিহ্যাব সেন্টারে হয়তো নতুন কিছু নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে মৃত হলে, বিশেষ করে ক্ষমতাবান মানুষ বা বিশেষ পেশা বা শ্রেণির কারো মৃত হলে বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বেরিয়ে আসে। আসামিদের পরিণাম অনেক দূর পর্যন্তও গড়ায়। শেষমেশ কী হয় তা হয়তো অনেক ক্ষেত্রে জানা যায় না। মিডিয়া বা জনগণের সোচ্চারেও ভালো ফল পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে ও সমান গুরুত্বে সব কিছু চললে হয়তো একদিন এসব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ