মঙ্গলবার , ৩১ মার্চ ২০২০ | ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরীর খবর
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

ইসলামের ইতিহাসে মহামারি

Paris
মার্চ ৩১, ২০২০ ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস কভিড-১৯। এ সময় প্রতিটি দেশে কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ইসলামিক স্কলারদের দাবি হলো কোয়ারেন্টিন পদ্ধতিটি মহামারির বিস্তার রোধে প্রিয়নবী (সা.)-এর একটি নির্দেশনা। এ পন্থার সর্ব প্রথম প্রয়োগ ছিল ওমর (রা.)-এর যুগে। তাই বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত এই পদ্ধতির নির্দেশনা দিয়েছেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)।

 

কোয়ারেন্টিন বলতে যা বোঝায়

Quarantine শব্দটি মূলত ইতালীয় শব্দ Quaranta থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হলো ৪০ দিন। প্রাচীনকাল থেকে উপকূলীয় অঞ্চল সংক্রামক রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখতে আগত জাহাজকে ৩০ বা ৪০ দিন পর্যন্ত পৃথক রাখার নিয়ম ছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জাহাজ অবতরণের আগে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নোঙর করে থাকত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া প্লেগের মহামারি থেকে রক্ষার প্রয়াসে আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোয় কোয়ারেন্টিনের অনুশীলন শুরু হয়। (https://bit.ly/2yevTQ8)

মূলত কোয়ারেন্টিন বলতে বোঝায়, সংক্রামক রোগে সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে কোনো এক স্থানে আবদ্ধ রাখবে, যেন রোগের ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়া যায় এবং অন্যের মধ্যে রোগটি বিস্তার না করে। সুনিশ্চিতভাবে মহামারিতে আক্রান্ত হলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে তাকে নিবিড় পরিচর্যায় থাকতে হবে।

মহামারির বিষয়ে রাসুল (সা.) সুস্পষ্ট ভাষায় কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা দিয়েছেন। রাসুলের নির্দেশনা মতে, কেউ যেন আক্রান্ত অঞ্চলে প্রবেশ না করে এবং সেখান থেকে বেরও না হয়; বরং সেখান থেকে বের হওয়াকে রণাঙ্গন থেকে পলায়নের মতো বলা হয়েছে, যা কবিরা গোনাহের শামিল। তেমনি মহামারিতে ধৈর্যধারণকারীদের জন্য থাকবে শহীদের মতো সওয়াব।

 

হাসপাতালে প্রথম কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা

কুষ্ঠরোগীসহ অন্য গুরুতর সংক্রামক রোগীদের হাসপাতালে পৃথক করে রাখার ব্যবস্থা শুরু হয় হিজরি প্রথম শতাব্দীতে (৭০৬-৭০৭ খ্রি.)। ইসলামের ইতিহাসের উমাইয়া খেলাফতের ষষ্ঠ খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের তত্ত্বাবধানে দামেস্কে সর্ব প্রথম হাসপাতাল তৈরি করা হয়। সেখানে কুষ্ঠরোগী ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের পৃথক রাখার নির্দেশনা দেন। (https://bit.ly/33VTDEs)

 

মহামারি বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর মূলনীতি

এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস উসুল তথা মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা যাবে। প্রথমত, উসামা বিন জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তুমি কোনো অঞ্চলে মহামারির প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে তাতে প্রবেশ করবে না। তবে সেখানে থাকাবস্থায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে তুমি সেখান থেকে বের হবে না।’ (বুখারি, হাদিস নং : ৫৭২৮)

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে মহামারি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি ইরশাদ করেছেন, তা একটি আজাব। আল্লাহ তাআলা যাদের ইচ্ছা তাদের কাছে প্রেরণ করেন। আল্লাহ তা মুমিনদের জন্য রহমত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাই কেউ মহামারিতে আক্রান্ত হলে সে যেন ধৈর্যধারণ করে এবং সওয়াবের আশা করে নিজের এলাকায় অবস্থান করে। এ বিশ্বাস রাখবে যে আল্লাহ তাআলা তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন সে তাতে আক্রান্ত  হবে, তাহলে সে শাহাদাত বরণকারীর সওয়াব লাভ করবে।’ (বুখারি, হাদিস নং : ৩৪৭৪)

 

ইসলামের দৃষ্টিতে সংক্রামক রোগ

ইসলামের দৃষ্টিতে শরীরে রোগ-ব্যাধি দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ, আবার তাঁর ইচ্ছায়ই আরোগ্য লাভ করা যায়। কোনো বস্তুর বা ব্যক্তি কাউকে রোগাক্রান্ত করতে পারে না, আবার তা থেকে সুস্থ করে তুলতেও পারে না। আমাদের জীবন-মৃত্যু, সুস্থতা অসুস্থতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই। তাই মহান আল্লাহ বিভিন্ন রোগ যেমন সৃষ্টি করেছেন, তার প্রতিষেধকও সৃষ্টি করেছেন, বান্দা কখনো কখনো তাঁর দয়ায় সেই প্রতিষেধক জানতে পারে, আবার কখনো কখনো জানতে পারে না। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার নিরাময়ের উপকরণ তিনি সৃষ্টি করেননি। (বুখারি, হাদিস : ৫৬৭৮)

কোনো রোগ আপন শক্তিতে মানুষকে আক্রান্ত কিংবা হত্যা করার শক্তি রাখে না, এটাও সত্য। কিন্তু তাই বলে কোনো এলাকায় রোগ-ব্যাধি দেখা দিলে সেখানে অসতর্ক অবস্থায় চলাফেরার অনুমতিও ইসলাম দেয়নি। কোনো এলাকায় মহামারি কিংবা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে মহানবী (সা.) সেখানে যাতায়াত করতে বারণ করেছেন। এর আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে কোথাও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আমাদের অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

আর ‘সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই’ বলতে যে হাদিসটি উল্লেখ করা হয়েছে, তার মানে হলো, রোগের কোনো নিজস্ব শক্তি নেই মানুষকে আক্রান্ত করার। তবে যেহেতু রাসুল (সা.) এ সময় সতর্ক থাকতে বলেছেন, তাই কোথাও এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আমাদের অবশ্যই যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ কারণেই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।’ আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে রাসুল (সা.) ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নাই বললে বেদুঈন আরব জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল, তবে সেই উটপালের অবস্থা কি যা কোনো বালুকাময় প্রান্তরে অবস্থান করে এবং সুস্থ সবল থাকে? অতঃপর সেখানে কোনো খুজলি-পাঁচড়ায় আক্রান্ত উট তাদের মধ্যে এসে পড়ে এবং সবগুলোকে ওই রোগে আক্রান্ত করে ছাড়ে? (এর জবাবে) তিনি বলেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে রোগাক্রান্ত করেছিল? যে মহান আল্লাহ প্রথম উটটিকে রোগাক্রান্ত করেছিলেন তিনিই তো অন্যান্য উটকে আক্রান্ত করেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৫৭৪২)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অসুস্থ উটগুলোর মালিক তাঁর উটগুলোকে সুস্থ পশুর দলে পাঠিয়ে দেবে না। (কারণ এতে ওই সুস্থ প্রাণীগুলো রোগাক্রান্ত হতে পারে।) (মুসলিম, হাদিস : ২৮৭৩)

তাই আমরা সংক্রামক রোগকে মহান আল্লাহর হুকুমের চেয়ে শক্তিশালী ভাবার যেমন কোনো সুযোগ নেই, তেমনি কোথাও এ ধরনের রোগ দেখা দিলে তাকে অবহেলা করারও সুযোগ নেই। আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা।

মহামারি থেকে যেভাবে ওমর (রা.) বেঁচে ছিলেন

ফিলিস্তিনের আল কুদস ও রামলার মধ্যভাগে অবস্থিত একটি অঞ্চল হলো আমওয়াস বা ইমওয়াস। সেখানে প্লেগ রোগ প্রথম প্রকাশ পায়। অতঃপর তা শামে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের ইতিহাসে তা ‘তাউন ইমওয়াস’ নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ইমওয়াস অঞ্চল পুরোপুরি ধ্বংস করে ওই স্থানে কানাডাভিত্তিক ইহুদি তহবিলের অর্থায়নে একটি পার্ক তৈরি করা হয়। বর্তমানে তা ‘কানাডা পার্ক’ নামে সবার কাছে পরিচিত।

১৭ হিজরি ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ওমর (রা.) দ্বিতীয়বারের মতো শাম পরিদর্শনের জন্য বের হন। ওমর (রা.) শামে পৌঁছার পর শুনতে পান যে সেখানে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে।

আবদুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত, উমর বিন খাত্তাব (রা.) শামের উদ্দেশে বের হন। শামে অবস্থিত তাবুক গ্রামের ‘সারগ’ নামক এলাকার কাছে এলে সেনাপতি আবু উবাদাহ ও অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা হয়। ওমর (রা.)-কে তাঁরা অবহিত করল যে শামে মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের কথা শুনে ওমর (রা.) আমাকে বলেন, ‘ইসলামের প্রথম পর্যায়ের মুহাজিরদের ডাক দাও।’ তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। কেউ বললেন, আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। তা না করে ফিরে যাওয়া আমরা সমীচীন মনে করছি না। অনেকে বলল, আপনার সঙ্গে অনেক মানুষ ও রাসুল (সা.)-এর মহান সাহাবিরা আছেন। এমতাবস্থায় তাঁদের নিয়ে আপনি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যাবেন না।

সবার কথা শুনে ওমর (রা.) বলেন, ‘তোমরা চলে যাও।’ অতঃপর ওমর (রা.) আমাকে বললেন, ‘আনসারদের আমার কাছে ডেকে আনো।’ তাঁদের ডেকে পরামর্শ করলেন। তাঁরাও মুহাজিরদের মতো মতবিরোধ করল। তিনি বলেন, ‘তোমরা চলে যাও।’ অতঃপর আমাকে বলেন, ‘এখানে কুরাইশ বংশের প্রবীণ মুহাজির সাহাবিদের ডাক দাও।’ আমি তাদের ডেকে আনি। তাঁদের মধ্যে দুজনও মতবিরোধ করল না। সবাই অভিন্ন কথা ব্যক্ত করে বলল, আমরা মনে করছি, আপনি সব মানুষকে নিয়ে ফিরে যাবেন। মানুষকে এই মহামারিতে নেবেন না।’

অতঃপর ওমর (রা.) সবাইকে সামনে নিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘আমি চলে যাব। তোমরাও চলে যাও।’ [তখন শামের গভর্নর ছিলেন আবু উবাদায় বিন জাররাহ (রা.)] এ কথা শুনে আবু উবাদাহ (রা.) বললেন, ‘আপনি আল্লাহর তাকদির থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন?’ ওমর (রা.) বলেন, ‘আহ, হে আবু উবাদাহ, এমন কথা তুমি ছাড়া অন্য কেউ বলত!’ মূলত ওমর (রা.) তাঁর মতভিন্নতাকে অপছন্দ করেছেন।

ওমর (রা.) আবু উবায়দার প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদির থেকে অন্য তাকদিরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছি। যেমন মনে করো, তোমার অনেক উট আছে। তা নিয়ে তুমি এক উপত্যকায় এসেছ। উপত্যকার দুটি প্রান্ত আছে। এক প্রান্ত উর্বর। আরেক প্রান্ত শুষ্ক। তুমি উর্বর প্রান্তে উট চরালে কি আল্লাহর তাকদিরের ওপর নির্ভর করবে না? এবং শুষ্ক প্রান্তে  চরালেও কি আল্লাহর তাকদিরের ওপর নির্ভর করবে না?’

কিছুক্ষণ পর আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) এলেন। কোনো এক প্রয়োজনে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, এ বিষয় সম্পর্কে আমার জ্ঞান আছে। আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে শুনেছি, ‘তোমরা কোনো অঞ্চলে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে তাতে প্রবেশ করবে না। তবে সেখানে থাকাবস্থায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।’ এ কথা শুনে ওমর (রা.) আলহামদুলিল্লাহ বললেন। অতঃপর সবাই ফিরে গেলেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭২৯)

ওমর (রা.) মহামারি চরম আকার ধারণের খবর অবগত হন। ওমর (রা.) চাইলেন সেনাপতি আবু উবায়দা (রা.)-কে ফিরিয়ে আনতে। তাই ওমর (রা.) একটি চিঠি লিখলেন, ‘তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ হোক। তোমার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে সরাসরি তোমাকে বলতে চাই। তাই তোমাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলছি, আমার পত্র পড়ে আমার উদ্দেশে বের হওয়ার আগে পত্রটি তোমার হাতছাড়া করবে না। রাতে পত্র পৌঁছলে সকাল হওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করবে। আর দিনের বেলায় পৌঁছলে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যাত্রা শুরু করবে।’ আবু উবায়দা (রা.) পত্র পড়ে উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমিরুল মুমিনিনকে ক্ষমা করুন।’ অতঃপর ওমর (রা.)-এর উদ্দেশে একটি পত্র লিখলেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আমি আপনার প্রয়োজনের বিষয় বুঝেছি। আমি এখন মুসলিম সেনাবাহিনীতে অবস্থান করছি। তাদের ছেড়ে যেতে চাই না। আল্লাহ তাআলা আমিসহ সবার ব্যাপারে ফায়সালা করবেন। অতএব হে আমিরুল মুমিনিন, আপনার সিদ্ধান্ত থেকে আমাকে মুক্ত করুন। আমার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দিন।’

আবু উবায়দা (রা.)-এর পত্র পড়ে ওমর (রা.) কাঁদতে থাকেন। আশপাশের মুসলিমরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আবু উবায়দা কি শহীদ হয়েছেন? ওমর (রা.) বলেন, ‘না, তিনি এখনো শহীদ হননি। কিন্তু …।’ অর্থাৎ শিগগির তিনি শহীদ হবেন।’  এর পরই আবু উবায়দা (রা.) প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৭/৪৪)

 

মহামারিতে বড় সাহাবিদের ওফাত

অনেক বড় বড় সাহাবি আমওয়াস নামক মহামারিতে আক্রান্ত  হয়ে ইন্তেকাল করেন। আবু উবায়দা বিন জাররাহ (রা.), মুআজ বিন জাবাল (রা.), ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান (রা.), হারিস বিন হিশাম (রা.) সুহাইল বিন আমর (রা.), উতবাহ বিন সুহাইল (রা.)-সহ আরো অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। এই মহামারি দীর্ঘদিন পর্যন্ত শামে বিরাজ করে। শামের অধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণের পর মুসলিমদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ থেকে ৩৬ হাজারের মতো। আর মহামারিতে এ সময় মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বহাল থাকে।

 

ওমর (রা.)-এর যুগে যেভাবে মহামারির সমাপ্তি ঘটে

আবু উবায়দা (রা.) পরবর্তী সেনাপতি হিসেবে মুআজ বিন জাবাল (রা.)-কে নির্ধারণ করেন। মুআজ (রা.)-এর মৃত্যুর পর আমর ইবনুল আস (রা.)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। তিনি মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়ে বলেন, ‘হে লোকেরা, এই রোগের প্রাদুর্ভাব হলে তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তাই তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নাও। এক বর্ণনা মতে, তোমরা পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন উপত্যকায় চলে যাও।’ অতঃপর সবাই বেরিয়ে পড়ে। বিভিন্ন পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অবশেষে আল্লাহ তাআলা এই বিপদ থেকে তাদের মুক্ত করেন। আমর (রা.)-এর গৃহীত পন্থা খলিফা ওমর (রা.) জানতে পারেন। তিনি তা অপছন্দ করেননি। (ফাতহুল বারি, ১০/১৯৯)

 

হিজরি নবম শতাব্দীতে পবিত্র মক্কার মহামারির চিত্র

ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, মহামারির কারণে অনেক সময় মসজিদও বন্ধ ছিল। এমনকি পবিত্র মক্কা নগরীর হারম শরিফও নিরাপদ ছিল না তখন। তাই সবই জনশূন্য।

প্রখ্যাত হাদিসবিশেষজ্ঞ আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) (মৃত্যু : ৮৫২ হি.) ৮২৭ হিজরিতে মক্কায় প্রকাশ পাওয়া মহামারির ঘটনা বর্ণনা করেন, ‘এ বছরের শুরুতে মক্কায় মহামারি দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন ৪০ এরও বেশি লোক মারা গিয়েছে। শুধু রবিউল আউওয়াল মাসে ১৭ শয়ের বেশি লোক মৃত্যুবরণ করেছে। ওই সময় কেবল দুজনকে নিয়ে মাকামে ইবরাহিমের সামনে (শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী) ইমাম নামাজ পড়াত। আর অন্যান্য মাজহাবের অনুসারী ইমামরা মুসল্লির অভাবে নামাজের ইমামতি করত না। তবে এখানে হারমে নামাজ পুরোপুরি বন্ধ থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত নয়। তবে মৃতের সংখ্যা, অসুস্থ ব্যক্তি ও সংক্রামক রোগ-ব্যাধির কারণে মানুষের উপস্থিতি তেমন ছিল না। কারণ মহামারি সংক্রমণের ভয় সবার মধ্যে। (ইনবাউল গুমরি ফি আবনাইল উমুরি, ৩/৩২৬)

 

হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে তিউনিশিয়ায় মহামারি

সপ্তম শতাব্দীর মরক্কোর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আজারি মারাকাশি বর্ণনা করেন, ৩৯৫ হিজরিতে তিউনিশিয়াতে মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। ফলে বস্ত্রের সংকট দেখা দেয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অনেক ধনী নিঃস্ব হয়ে পড়ে। চিকিৎসা, শুশ্রূষা ও মৃতের দাফনকর্মে সবাই ব্যস্ত ছিল। কাইরাওয়ান নগরীর মসজিদগুলো বিরান হয়ে পড়েছিল তখন।’ (আল বায়ানুল মুগরিব ফি আখবারিল আন্দালুস ওয়াল মাগরিব, পৃষ্ঠা : ২৭৪)

 

হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে আন্দালুসের মহামারি

প্রখ্যাত হাদিসবিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক ইমাম জাহাবি (রহ.) (মৃত্যু : ৭৪৮ হি.) লিখেছেন, আন্দালুসে (বর্তমান স্পেন) ৪৪৮ হিজরিতে কঠিন দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দিয়েছিল। তখন গ্রানাডায় এত লোকের মৃত্যু হয়েছিল যে সেখানকার মসজিদগুলো মুসল্লি না থাকায় বন্ধ হয়ে যায়। কর্ডোভা নগরী এ ধরনের দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সম্মুখীন হয়নি কখনো। তাই এ বছরটি ক্ষুধার বছর হিসেবে পরিচিত।’ (তারিখুল ইসলাম, সিয়ারু আলামিন নুবালা)

 

পঞ্চম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ায় মহামারি

প্রখ্যাত ফকিহ ও হাদিসবিশেষজ্ঞ আল্লামা ইবনুল জাওজি (রহ.) (মৃত্যু : ৫৯৭ হি.) মধ্য এশিয়া ছড়িয়ে পড়া ভয়ংকর মহামারির কথা বর্ণনা করেছেন। প্রায় ২০ লাখের মতো লোক মৃত্যুবরণ করে এতে। তিনি লিখেছেন, “৪৪৯ হিজরির জুমাদাল উখরায় ‘মাওয়ারাআন নাহার’ বা ট্রান্সঅস্কিয়ানার ব্যবসায়ীদের একটি পত্র পাওয়া যায়। সেখানে সীমাহীন কষ্টের এক মহামারি দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন এই অঞ্চল থেকে ১৮ হাজার মৃতদেহ দাফনের জন্য বের করা হয়েছে। এই পত্র লেখা পর্যন্ত  মৃতের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৫০ হাজারের মতো!”

লেখক তখনকার কঠিন সময়ের বর্ণনা দিলেও তা বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি দেশের চিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পূরক। তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘এই অঞ্চলে মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল। কিন্তু এখন আর মানুষের কোনো চিহ্নও দেখা যায় না। সব বাজার বিরান হয়ে আছে। জনশূন্য পথ-ঘাট। সব ঘরের দরজাও বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সব কাজকর্ম থেমে আছে। মানুষের রাত-দিনের পুরো সময় কাটে মৃতলোকদের গোসল ও দাফনের ব্যবস্থা করতে করতে। বেশির ভাগ মসজিদ মুসল্লিশূন্য হয়ে পড়ে আছে। (আল মুনতাজাম ফি তারিখিল উমাম, ১৬/১৭)

 

দোয়া মাহফিলে সমাগম মহামারি বাড়িয়ে দিল!

আল্লামা ইবনে হাজর (রহ.) (মৃত্যু : ৮৫২ হি.) মহামারির সময় জমায়েতের বিরূপ প্রভাবের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাতে তিনি বর্ণনা করেন, ‘৮৩৩ হিজরিতে মহামারির সময়ে শিহাবুদ্দিন শরিফ নামের এক ক্ষমতাধর লোক ৪০ জন সম্মানিত ব্যক্তিকে একত্রিত করেন। তাঁদের প্রত্যেকের নাম ছিল মুহাম্মাদ। সবাইকে অর্থ প্রদান করা হয়। শুক্রবারে জুমার পর থেকে জামিউল আজহারে বসে তাঁরা কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন। আসরের সময় সন্নিকটে হলে তাঁরা উচ্চৈঃস্বরে দোয়া করা শুরু করেন। তাঁদের আওয়াজ শুনে অনেক লোক আসা শুরু করে। অতঃপর ৪০ জন মিলে দালানের ছাদে উঠে আজান দেওয়া শুরু করেন। তাঁদের এমন অবস্থা দেখে এক লোক শরিফকে বলল, এঁদের কারণে মহামারি আরো ছড়াবে। অতঃপর তাই হয়েছে। মহামারি দিন দিন আরো বাড়তে থাকে।’ (ইনবাউল গুমরি ফি আবনাইল উমুর, ৩/৩৫৬)

 

মহামারি বেড়ে গেল হজযাত্রীদের আগমনে

৮৪৮ হিজরিতে মিসরে মহামারি ছিল। মহামারির কারণে প্রতিদিনই এক শ বা দুই শ লোক মারা যেত। মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। অতঃপর হজের সময়ে হাজিরা আসতে শুরু করে। এতে করে মৃতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এমনকি হাজিদের শিশুসন্তান ও দাসদের অনেকে মারা যায়। প্রতিদিন হাজারেরও বেশি লোক মারা যায়। দেখা যায়, হাজিদের আগমনে মহামারি আরো বিস্তার লাভ করেছে।’ (ইনবাউল গুমরি ফি আবনাইল উমুরি)

ইবনে হানবলি আল হালবি (রহ.) (মৃত্যু : ৯৭১ হি.) বর্ণনা করেছেন, হালবে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। শাহ মুহাম্মাদ দাকনি নামের এক শিক্ষার্থীর বাবা হোম কোয়ারেন্টিন পরিত্যাগ করে সঙ্গে থাকা সবাইকে নিয়ে এক বাগানে গিয়ে ওঠেন। মৃত্যুকে তিনি খুবই ভয় করতেন। আল্লাহ তাঁকে এবার রক্ষা করেন। কিন্তু অন্য এক মহামারিতে পিতা-পুত্র উভয়ে মৃত্যুবরণ করে। (দুররুল হুবাব ফি তারিখিল হালব)

hedaetullah2015@gmail.com

 

দুর্যোগের সময় বায়তুল্লাহ  মসজিদনববী

মদিনায় ইয়াজিদ বিন মুআবিয়ার আক্রমণ : যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে অনেক সময় মক্কা ও মদিনার দুই মসজিদে নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত বন্ধ ছিল। ৬৩ হিজরিতে ইয়াজিদ বিন মুআবিয়া (রা.)-এর বিরুদ্ধে মদিনাবাসী বিদ্রোহ করে। প্রখ্যাত হাদিসবিশেষজ্ঞ আল্লামা কাজি ইয়াজ (রহ.) (মৃত্যু : ৫৪৪ হি.) ওই সময় মদিনায় ইয়াজিদের বাহিনীর কৃত তাণ্ডবলীলার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ইয়াজিদের বাহিনী মদিনাবাসীকে পরাস্ত করে হত্যা করা শুরু করে। তিন দিন পর্যন্ত  হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে। এ সময় আনসার ও মুহাজিরসহ অনেক সাহাবির সন্তানরা নিহত হয়। ওই সময় মসজিদ-ই-নববীতে নামাজ বন্ধ থাকে। এমনকি আজানও হয়নি তখন।’ (ইকমালুল মুলিম বিফাওয়ায়িদি মুসলিম, ৬/২৬১)

মক্কা ও মদিনায় ইসমাইল উখাইদির সাফফাকের আক্রমণ : প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আবদুল মালিক ইসামি আল মক্কি (মৃত্যু : ১১১১ হি.) বর্ণনা করেন, ‘ইসমাইল উখাইদির মক্কায় প্রবেশ করলে সেখানকার আব্বাসি খলিফার গভর্নর পালিয়ে যান। তাই ইসমাইল এসে তাঁর ঘরে আক্রমণ করে ও মানুষের সম্পদ লুটতরাজ করে। দীর্ঘদিন অবস্থান করে মদিনায় গেলে সেখানকার গভর্নরও পালিয়ে যান। সেখানেও সব কিছু ধ্বংস করে। এ সময় প্রায় ১৫ দিন পর্যন্ত মসজিদ-ই-নববীর নামাজ বন্ধ থাকে। (সামতুন নুজুম আওয়ালি)

পবিত্র কাবায় কারামাতিদের আক্রমণ : শিয়াদের একটি দল হলো কারামাতি। ইরাকের আব্বাসি শাসক ও মিসরে উবায়াদি শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে আরব উপদ্বীপের পূর্ব প্রান্তে বাহরাইনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাদের বিশ্বাস ছিল, হজ জাহেলি যুগের একটি নিদর্শন। হজ মূর্তির উপাসনার মতো। তাই ইসলামের ফরজ বিধান হজ বন্ধ করতে কারামাতি শাসকরা তৎপর হয়ে ওঠে। মূলত ইসলামের ইতিহাসে হজ ফরজ হওয়ার পর কারামাতিরা সর্ব প্রথম কাবায় আক্রমণ করে হাজিদের হত্যা করে।

৩১৭ হিজরি ৯৩০ খ্রিস্টাব্দ ছিল মুসলিমদের বেদনাদায়ক ইতিহাস। বাতিল ফেরকায় বিশ্বাসী বাহরাইনের শাসক আবু তাহের কারামাতির নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী সর্ববৃহৎ হাজিদের কাফেলায় আক্রমণ করে। অনেক নারী-পুরুষকে হত্যা করে এবং তাদের সম্পদ ছিনতাই করে। ইরাক ও শাম থেকে মক্কা আসার পথে তারা আতঙ্ক তৈরি করে। ফলে ৩১৭ হিজরি থেকে ৩২৭ হিজরি পর্যন্ত  হজের কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

শুধু তা-ই নয়, এ সময় কারামাতি শিয়ারা কাবা প্রাঙ্গণে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি লোক মারা যায়। মক্কার গভর্নরকে হত্যা করে অলিতেগলিতে সব মুসলিমকে তারা হত্যা করতে থাকে। গোসল ও কাফন-দাফন ছাড়াই তাদের কবর দেওয়া হয়। কাবার গিলাফ ছিঁড়ে সব দরজা ভেঙে ফেলা হয়। সর্বশেষ তারা যাওয়ার সময় সঙ্গে করে হাজরে আসওয়াদ নিয়ে যায়। প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় হাজরে আসওয়াদ মক্কায় ছিল না। বাহরাইনের হাজর নামক স্থানে আবু তাহের একটি প্রাসাদ নির্মাণ করে। ‘দারুল হিজরাহ’ নামের এই প্রাসাদে হাজরে আসওয়াদ রাখা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ যেন কাবায় গিয়ে হজ না করে। সবাইকে দারুল হিজরায় আনতেই এমনটি করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর আব্বাসি খলিফা অনেক দিনারের বিনিময়ে তা আবার কাবার পাশে স্থাপন করেন।

(তারিখুল ইসলাম, আজ জাহাবি, ২৩/৩৭৪)

সর্বশেষ - ধর্ম