আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্য কী- মানুষ হওয়া নাকি সম্পত্তি গড়া?

‘আমি আমার চার বছরের অনার্স জীবনের প্রত্যেকটি পরীক্ষায় পেছনের দিক থেকে প্রথম হওয়া সত্ত্বেও একদিনও বেকার না থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে সোজা কর্মস্থলে যোগদান করেছি।’ ওপরের কথাগুলো একজন সহকারী কমিশনারের (ভূমি); যিনি অনেক গর্ব করে বুক ফুলিয়ে কোনো একটি অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছিলেন। সে অনুষ্ঠানে মূল দর্শক-শ্রোতা ছিলেন মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা। সেই সহকারী কমিশনার সাহেব আরও যুক্ত করে বলেন যে, উনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ব্যাচের আরো যে চারজন প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন তারা সবাই ক্লাসের পেছনের সারির ছাত্র। পেছনের সারির ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে তারা প্রশাসন ক্যাডারের মতো জায়গায় নিয়োগ পেলেন সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, প্রথম থেকেই তারা বিসিএস সিলেবাস অনুযায়ী পড়া-লেখা করতেন। মাঝে মধ্যে ক্লাসে যাওয়া কিংবা ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের অধ্যয়নটা ছিল শুধু পরীক্ষায় কোনোরকমে পাসের জন্য।

এরকম একটি প্রেক্ষাপটে কয়েকটি চ্যালেঞ্জিং প্রশ্নের জন্ম হয়- ক) বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের/শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা? খ) কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সিলেবাস বা কারিকুলাম রয়েছে তার আদৌ দরকার আছে কিনা? গ) কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত অনার্স-মাস্টার্সের সনদপত্রের আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে কিনা, নাকি নিছকই একটি মানদণ্ড নির্ধারণের ব্যাপার এটি? বাংলাদেশে আজকে প্রশাসনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি পুঞ্জীভূত হয়েছে অথবা বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশাসকদের কার্যক্রমের ব্যাপারে যে নেতিবাচক ‘পাবলিক পারসেপশন’ তৈরি হয়েছে সেটির আসলে উৎস কোথায়।

গত দেড় দশকে সরকারি চাকরি যেভাবে সোনার ডিমপাড়া হাঁসের মতো হয়ে উঠেছে তাতে করে আমাদের ছেলেমেয়েরা ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার’ পেছনে যে ছুটবে তাতে দোষের কী? আমাদের ছাত্রছাত্রীরা এখন কেবল একটি সরকারি চাকরি পাওয়াকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়েছে। জীবনের সফলতা বলতে কতবেশী বেতনের চাকরি করা হয়, বেতন বহির্ভূত আয়ের সম্ভাবনা কতটুকু, বেতন বহির্ভূত আয়ের মাধ্যমে অর্থ-বিত্তের জৌলুস কিংবা দামি গাড়ি-বাড়িকেই মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তা একটি জাতির জন্য যে অশনি সংকেত সেটি প্রমাণের জন্য সুদূর অতীতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যখনই যে সভ্যতাতেই কেবল বৈষয়িক উন্নতির চিন্তা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সেখানেই সামগ্রিক পচন ও পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। যেখানে মানবিকতাকে ছাপিয়ে অর্থ, অর্থ এবং অর্থই হয়েছে সবকিছুর মাপকাঠি। আজ তথাকথিত উন্নত সমাজ থেকে শুরু করে আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলোর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সম্পদ অর্জন কিংবা সম্পদ বৃদ্ধির যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সবকিছুকে তছনচ করে ফেলছে তাতে সবাই শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

যাদের আজকে নিরানব্বই কোটি কিংবা নিরানব্বই হাজার কোটি টাকা আছে সে-ই সমাজের সবচেয়ে আগ্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাকি এক কোটি কিংবা এক হাজার কোটির নেশায় মত্ত, উন্মাদ। যেভাবেই হোক তাদের ‘একশ’ পুরাতেই হবে, যদিও তা কখনোই পরিপূর্ণ হওয়ার মতো কোন জিনিস নয়। এ যেন ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি’র বাস্তব মঞ্চায়ন। ‘লজ্জা’ নামক ভূষণটি এখন তাচ্ছিল্যের পাত্রে পরিণত হয়ে সেকেলে জিনিস হিসেবে জাদুঘরে আশ্রয় নিচ্ছে। পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ কিংবা ভালোবাসা প্রদর্শনের যে ঐতিহ্য আমাদের গর্বের জায়গায় ছিল এখন তা লুপ্তপ্রায়। আমাদের দেশের জাতীয় দৈনিকে যখন শিরোনাম হয় ‘করোনায় কোটিপতি’ অথবা ‘করোনাকালেও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ’ সেখানে এসবের রুট খুঁজে বের করতে না পারলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এসবের জন্য আমাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ একটি গণমাধ্যমের পরিসংখ্যান রিপোর্টে দেখা গেছে, করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের আয় তলানিতে নেমে গেলেও ব্যাংকে কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা ৩ হাজার ৪১২টি বেড়ে ৮৬ হাজার ৩৭ জনে দাঁড়িয়েছে। গত মার্চ মাসে যে সংখ্যাটি ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। বিবিএস এবং বিভিন্ন উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে দেশে বর্তমানে ৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। যদিও গত এক যুগে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। এক হিসাব মতে, ২০০৮ সালে দেশের ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ জন। করোনাকালে দেশের ৭২.৬ শতাংশ পরিবারের আয় কমলেও এক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন ও উল্টোমুখী। বরং বাড়িতে বসে মাঝে মধ্যে ’জুম মিটিং’ করে কোটি কোটি টাকা বিল করার খবর পত্রিকা মারফত জাতি জানতে পেরেছে।

এখন আসা যাক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। যে প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থী একজন প্রশাসক হয়ে ওঠেন সেখানে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসের প্রয়োজন গৌন হয়ে দেখা দেয়, পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তে কোচিংনির্ভর সিলেবাস সম্পন্ন করে বিসিএসসহ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে সফলতা পাওয়া যায় তাহলে সেখানে ভাবনার জায়গাটি অনেক বড়। আমার অনেক ছাত্রছাত্রীকে এটি বলতে শুনেছি যে, কোচিং সেন্টারগুলোতে নাকি মিথ্যা কথা কীভাবে শৈল্পিক প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করতে হয়- সেসব শেখানো হয়। এটাই নাকি ‘স্মার্টনেস’! নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য এসব এখন ‘কৌশলের’ পদতলে পিষ্ট।

আজকে কী আমরা শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি! যে শিক্ষা আমাদের মানবিক হতে, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে সাহায্য করার কথা তা আজ শুধুই সম্পদের পাহাড় গড়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে থাকছে না বিবেকের ন্যূনতম চেতনা। অন্যের অধিকার হরণ করার পাশবিক শক্তি আজ অপ্রতিরোধ্য, তাকে থামানোর কোন শক্তিই আর যেন অবশিষ্ট নেই। স্কুল পালিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল হওয়ার বাসনা আজ আমাদের ছেলেমেয়েদের যেভাবে শ্রেণিকক্ষ বিমুখ করছে তাতে তথাকথিত ‘সফল’ ব্যক্তিদের ছবি সংবলিত খবর পত্রিকার পাতায় ছাপা হয় কখনো ‘বালিকাণ্ড’ আবার কখনো ‘বন খেকো ওসমান গনি’ কিংবা ‘বাধ্যতামূলক ছুটিতে ডাক অধিদফতরের ডিজি সুধাংশু’ অথবা ‘১০ কাঠার প্লেট বাগাতে সবকিছুই করেছেন সদ্য বিদায়ী বিদ্যুৎ-সচিব’ ইত্যাদি হাজারো শিরোনামে। আর এ ধরনের খবর যে প্রতিনিয়ত জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা সুধিমহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। ১১ নভেম্বর ২০২০ একটি জাতীয় দৈনিকে খবর ছাপা হয়েছে ‘দুর্নীতিতে বেশি গ্রেপ্তার সরকারি চাকরিজীবীরা’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়েছে গত ৫ বছরে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭৯৯ জন। এদের মধ্যে ৩৯০ জনই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। আর বাকি ৪০৯ জনের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, ব্যাংক-বিমাসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই খবরে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছাপানো হয় তা হলো, গত ৫ বছর আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতন ৯১ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল এই আশায় যে তারা দুর্নীতি ছেড়ে দেবে। এমনকি করোনা মহামারিকালে দুর্নীতির অভিযোগে দুদক যাদের তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তাদের অধিকাংশই এ খাতের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। অথচ এটি হওয়ার কথা ছিল না। এসব কি শুধুই একটি পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার তাড়নায় হয়ে থাকে? না, সেটি হওয়ার কথা নয়। কারণ আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে ধরনের আর্থিক সুরক্ষা পেয়ে থাকেন তাতে অনায়েসে তাদের কয়েক প্রজন্ম নির্ভার থাকতে পারেন। সম্প্রতি আমাদের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন কানাডার শুধু টরেন্টো শহরেই ২৮ জন বাংলাদেশির বাড়ি আছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন; যাদের মধ্যে সিংহভাগই হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা আর তাদের ছেলেমেয়েদের প্রায় সবাই সেখানে লেখাপড়া করছেন। কাজেই নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত ‘দক্ষতা’ দিয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রের যে সুষম টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা নীতিনির্ধারকদের ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে এবং আসল গলদটি কোথায় তা খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি।

মো. রবিউল ইসলাম
শিক্ষক, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
Email: mdrabi_ju@yahoo.com

 

সুত্রঃ যুগান্তর