আদিবাসী কৃষকের আত্মহত্যা: রহস্য উদঘাটনে অন্ধকারে পুলিশ, বিএমডিএ’র তদন্ত কমিটি গঠন

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে বোরো ধানের জমিতে পানি না পেয়ে কিটনাশক পান করে আদিবাসী দুই কৃষক আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই দুই কৃষকের আত্মহত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে অন্ধকারেই রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে গত শুক্রবার রাতে নিহত আদিবাসী কৃষক অভিনাথ মারান্ডির স্ত্রী রোজিনা মারান্ডি আত্মহত্যার প্ররোচণার অভিযোগ এনে বিএমডিএ এর গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে গোদাগাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। এরই মধ্যে দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিএমডিএ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

রবিবার (২৭ মার্চ) গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমঘুটু গ্রামে সরেজমিন পর্যবেক্ষণে নিহতের পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১২ দিন ধরে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপে ঘুরেও নিহত দুই কৃষক তাদের বোরোর জমিতে পানি দিতে পারেনি। গত বুধবার (২৩ মার্চ) বিএমডিএর গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে এনিয়ে বাকবিতণ্ডা হয় তাদের। ওই দিন দুপুরেই তারা নাকি গভীর নলকূপের পাশেই কিটনাশক পান করে অভিনাথ ও রবি। ঘটনার দিন রাতেই অভিনাথ মারান্ডিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানেই মারা যায়। আর গত শুক্রবার রাতে অভিনাথ মারান্ডির চাচাতো ভাই রবি মারান্ডিও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।

তবে ঘটনার দিন সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে- আদিবাসী দুই কৃষক যেই স্থানে কীটনাশক পান করেছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে সেখানে কীটনাশকের কোনো বোতল কিংবা বোতল সদৃশ কোনো কিছুর হদিস মেলেনি। যার কারণে আসলেই তারা কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেছে নাকি চোলাই মদ বা অন্য কোনোকিছু খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন সেই বিষয়ে এখনও অন্ধকারে রয়েছে পুলিশ।

এদিকে দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে বিএমডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নাজিরুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। গতকাল রবিবার নিহত কৃষকের গ্রামে গভীর নলকূপের পাশে যেখানে কৃষকরা কীটনাশক পান করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেখানে যান তদন্ত কমিটির প্রধান নাজিরুল ইসলাম। জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। আমরা সরেজমিন তদন্তপূর্বক প্রাপ্ত রিপোর্ট শিগগিরই জমা দেবো।’

রবিবার ওই এলাকার একাধিক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন তাদের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য সিরিয়াল মেইনটেইন করেন না। হাবিব মুর্মু নামের এক কৃষক বলেন, ‘ধান লাগানোর পর সাখাওয়াত একদিনও আমার জমিতে পানি দেয়নি। পাশের নলকূপ থেকে এক ঘণ্টার জন্য ১১০ টাকায় পানি কিনতে হয়েছে।’ সত্তর বছর বয়সী কৃষক আমির হাসদা বলেন, ‘সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে তাদের জমিতে সেচ দিতে বিএমডিএ অপারেটরদের দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, ফলে ফলন খুব কম হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নলকূপের সক্ষমতা বেশি না হলেও গভীর নলকূপের পানি দিয়ে প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করা সম্ভব। কিন্তু অপারেটরের স্বজনপ্রীতির আর দুর্নীতির কারণে তা হচ্ছে না।’

তবে জানতে চাইলে বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. শামসুল হুদা বলেন, গভীর নলকূপের পাম্পের সক্ষমতা ৩০-৪০ একর জমির। আমরা সবসময় প্রায় ৩০-৪০ একর জমিতে পানি দেওয়ার পরামর্শ দিই কিন্তু কখনও কখনও কৃষকরা অপারেটরদের তার ক্ষমতার চেয়ে বেশি জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। ফলে নিয়মিতভাবে জমিতে পানি দেয়া সম্ভব নয়।

সরেজমিনে জানা গেছে- গভীর নলকূপ অরারেটর সাখাওয়া হোসেনের অধীনে ২৬০ বিঘা জমি রয়েছে। যার কারণে সিরিয়াল মেনে পানি দিতে হলে কোনো কোনো জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। তবে কৃষকদের অভিযোগ, সাখাওয়াতের সঙ্গে কিছু কৃষকের ভালো সম্পর্ক থাকায় তাদেরকে নিয়মিতভাবে পানি দিয়ে আসছিলেন। এমন অভিযোগ নিয়েই নিহত অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি পানির জন্য সাখাওয়াতের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা জড়িয়েছিলেন।

নিহত অভিনাথ মারান্ডির স্ত্রী রোজিনা মারান্ডি বলেন, ‘আমরা প্রায় দেড়-দুই বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। গত বুধবার দুপুরে আমার স্বামী ও দেবর রবি জমিতে পানি দিতে গেলে অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের তার ওপর চড়াও হয়। তখন আমার স্বামী ও দেবর তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো, জমিতে পানি না দিলে বিষপানে তারা আত্মহত্যা করবে। তখন সাখাওয়াত বলেছিলো, যাও তোমারা আত্মহত্যা করো। এরপরই তারা বিষপান করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে থানায় ইউডি মামলা হয়েছে। পরবর্তীতে আমি থানায় আত্মহত্যার প্ররোচণায় মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। দীর্ঘ সময় থানায় বসিয়ে রেখে শুক্রবার গভীর রাতে পুলিশ মামলা নেয়।’

গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের দাবি, ‘আমি নিয়ম মেনেই জমিতে পানি দিই। এখানে পক্ষপাতিত্ব করার কিছুই নেই।’

জানতে চাইলে গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আদিবাসীরা চোলাই মদে অভ্যস্ত। আসলে মারা যাওয়া দুই কৃষক বিষপানে নাকি চোলাই মদ কিংবা অন্য কোনোকিছু পান করে আত্মহত্যা করেছে সেই বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। কারণ ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে বিষের বোতল কিংবা বোতল সদৃশ কোনোকিছুই পাইনি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে আসলে জানা যাবে তারা বিষপানে নাকি মদ্যপানে মারা গেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষক নিহতের ঘটনায় থানায় একটি আত্মহত্যার প্ররোচণার মামলা হয়েছে। নিহত অপর কৃষকের পরিবারের পক্ষ থেকেও মামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আমরা সার্বিক বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জি/আর