আকাশ থেকে মৃত্যু নামে সিরিয়ায়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাড়ি থেকে বের হয়েই সামনের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন দুই মধ্যবয়সী সিরীয়। বিকারহীন, অসহায় ভঙ্গি! বাজপাখির মতো শিকারি চোখে তাকিয়ে আছেন আকাশে। মাঝে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে একটি শিশু।

তার চোখেও কৌতূহল। কিন্তু কী দেখছে তারা? ঈদের নতুন চাঁদ নাকি বর্ষা শেষের রংধনু? না, এসবের কিছুই না। আকাশের কোথায় যেন শোনা যাচ্ছে যুদ্ধবিমানের শব্দ। গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলছে। বাতাসে গমগম শব্দ।

বিমানগুলো হঠাৎ তাদের সীমানায় চলে আসে কিনা সেই আতঙ্কেই আকাশের এপাশ ওপাশ উল্টে-পাল্টে দেখছেন মানুষগুলো। হয়তো কোনো একটা বিমান হঠাৎই ব্যারেল বোমা ফেলবে তাদের বাড়ির ওপর। আর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সবকিছু। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে পরিবার-পরিজন।

মেঝেতে-দেয়ালে পড়ে থাকবে প্রিয়জনের থকথকে থেঁতলানো মাংসের ফালি। সিরিয়ায় দিনরাত মাথার ওপর চক্কর দেয় নানা শব্দের মারণবিমান। আর এভাবেই আকাশ থেকে নেমে আসে মৃত্যু।

শুধু একটি-দুটি পরিবার নয়, প্রতিদিন-প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় বাঁচে এমন লাখ লাখ পরিবার। একদিন দু’দিন নয়, গত সাত বছর ধরে এই কৌশলেই বেঁচে আছেন জীবিতরা।

সিরিয়ার যুদ্ধ এখন শেষের পথে। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সর্বশেষ ঘাঁটি ইদলিব প্রদেশের পুনর্দখল হলেই পুরো সিরিয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। সেই লক্ষ্যেই ইদলিবে অভিযান শুরু করেছে সরকারি ও মিত্র রুশবাহিনী।

সোমবার থেকে প্রদেশের অন্তত ৯টি শহরে বিমান হামলা চালিয়েছে। এসব শহরে সামরিক-বেসামরিক সব স্থাপনার ওপর বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে মর্টার, ক্ষেপণাস্ত্র ও ব্যারেল বোমা। নিহত হয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ। ইতিমধ্যে ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। হামলা থেকে ইতিমধ্যে পালিয়ে গেছে ৩০ হাজারের বেশি অধিবাসী।

পূর্বাঞ্চলের তুরস্ক সীমান্ত বন্ধ। লাখ লাখ মানুষের পালানোর বা বাঁচার কোনো পথ নেই। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তাই আকাশের দিকে একবার দেখে নেয়, যুদ্ধবিমান আসছে কিনা।

ইদলিবে অধিবাসীদের এই করুণ দুর্দশার বর্ণনা চিত্র ও লেখার মাধ্যমে বুধবার নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন খ্যাতনামা সাংবাদিক মারওয়ান হিশাম ও মলি ক্রাবাপেল। সিরিয়া যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে ‘ব্রাদার্স অব দ্য গান: আ মেমোয়ার অব দ্য সিরিয়া ওয়ার’ একটি বই লিখেছেন তারা।

যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে কীভাবে কাটছে ইদলিবের অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবন বইটিতে তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন। বুধবারের প্রতিবেদনে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিন অধিবাসীর সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন তারা।

ইদলিবের খান শেইখৌনের বাসিন্দা নির্মাণ শ্রমিক ইয়াসির (৩৩)। তিনি বলেন, সকালে উঠেই আমরা আগে টিভি-রেডিওর খবর শুনি। ইদলিবের ভাগ্যে কী আছে সেই আলাপেই আমাদের দিন যায়। একেকজন একেক কথা বলে।

কেউ বলে, পরিণতি যাই হোক রাশিয়া হামলা চালাতেই থাকবে। তিনি জানান, রুটি আর সবজি বিক্রি করা ছোট ছোট দোকানগুলো বাদে আর সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষিকাজ বন্ধ। নির্মাণ কাজও। কয়েকদিন আগেই পার্শ্ববর্তী একটি স্কুলে বোমা ফেলা হয়েছে। ভাগ্য ভালো যে, এটা বন্ধ ছিল।

ইয়াসির জানান, হামলা থেকে বাঁচতে মাটির নিচে বাঙ্কার খুঁড়ছে মানুষ এবং সেখানে খাদ্য মজুদ করছে। আমাদের আশঙ্কা, গত বছরের মতো আবার খান শেইখৌনে রাসায়নিক গ্যাস হামলা চালানো হতে পারে। কিছু লোক মুখোশ বানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু হামলা হলে এগুলোতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ গত বছর বহু লোক মারা গেছে।

কাফরানবেলের বাসিন্দা উম মোহাম্মদ। বয়স চল্লিশের উপর। পেশায় ঘরামি। বলেন, তিন ছেলে আর তাদের বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার সংসার। বড় ছেলে আলেপ্পোর ল স্কুলে পড়ত। ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হয়। পরিবারের খাবার জোটাতে আমার মতো নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যোগ দেয়।

এখন সেকাজও বন্ধ। ২০১৩ সালে কাফরানবেল এলাকায় বিমান হামলায় গুরুতর আহত হয় আমার ছোট ছেলে। পায়ে বোমার স্পি­ন্টার বিঁধে থাকায় এখনও ঠিকমতো হাঁটতে পারে না।

দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মোহাম্মদ বলেন, একটার পর একটা আঘাতে আজ আমরা ক্লান্ত। এই যুদ্ধ, মানুষের এসব দুঃখ-দুর্দশা বছরের পর বছর ধরে চলছে। চারপাশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে যখন আমরা কথা বলি, অনেকেই বলেন, এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের হাতে চলে যাক। তাতে অন্তত আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো চিন্তা থাকবে না। বাশার বাহিনী যদি ফের নিয়ন্ত্রণ নেয়, প্রত্যেককেই হত্যা করা হবে।