আওয়ামী লীগকে হাইব্রিডমুক্ত থাকতে হবে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আওয়ামী লীগের আসন্ন সম্মেলন সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ বলেন, সর্ববৃহৎ দল তাই একটু-আধটু সংঘর্ষ হতে পারে। এসব কথা বলে যারা সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন তারা সহিংসতার কারণগুলোকে শনাক্তসহ সমাধান না করে ধামাচাপা দিয়ে রাখেন।

ফলে সারা দেশে স্বচ্ছ রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। সংঘর্ষ হয় পদ-পদবির লোভে। একমাত্র কারণ, প্রতিটি পদ-পদবিই নেতা ও তাদের অনুগত ক্যাডারদের অর্থ আয়ের উৎস। এখানে নেতা ও ক্যাডার একে অপরের পরিপূরক। এ সংস্কৃতি বন্ধ না হলে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং প্রাণহানির রাজনীতি বন্ধ হবে না। একই দলের আদর্শ একই, সেখানে দ্বন্দ্বের কোনো সুযোগ নেই।

তাহলে অন্তর্দলীয় গ্রুপিং, সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটবে কেন? দীর্ঘদিন বাংলাদেশে যে কাজটি অন্য কেউ পারেনি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই কাজটি করতে পেরেছেন। এমনকি নিজ দলের লোকদের গ্রেফতার থেকে শুরু করে চ্যালেঞ্জিং অভিযানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এভাবে শুদ্ধি অভিযান জনগণের প্রথম প্রত্যাশা পূরণ করেছে। এখন অনৈতিকভাবে অর্জিত অর্থসম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে জনগণের দ্বিতীয় প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে অনেকে মনে করছেন। চলমান অভিযানে সরকারদলীয় কোনো ত্যাগী নেতা বা কর্র্মী ধরা পড়েনি। কারণ ত্যাগীরা সৎভাবে কাজ করেন। যারা ধরা পড়েছেন তাদের বেশিরভাগই হাইব্রিড নেতা। পাশাপাশি সরকারদলীয় লেবাসধারী সন্ত্রাসী। অভিযান সফল হলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো স্বচ্ছ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।

সিঙ্গাপুরে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই যা বাংলাদেশের আছে। সিঙ্গাপুরে কোনো ফসল হয় না। অথচ বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে সোনা ফলে। সিঙ্গাপুর তার দেশের খাওয়ার পানি পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করে। তারা উন্নতি করতে পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? মেট্রোরেল প্রকল্প ঢাকার রেলপথকে ইউরোপ ও সিঙ্গাপুরের সমপর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের বাকি উন্নয়নও সে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন নয়। প্রয়োজন টাকা পাচারের ফাঁকফোকর বন্ধ করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই পারবেন।

উন্নত দেশে অন্তর্দলীয় সংঘর্ষ ও প্রাণহানি নেই। ব্রিটেনে ১৮৩৪ সালে কনজারভেটিভ পার্টি ও ১৯০০ সালে লেবার পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় দলেই দৃশ্যমান অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং নেই। সংঘর্ষ নেই, প্রাণহানিও নেই। জন্মলগ্ন থেকে তেমন কোনো রেকর্ড ব্রিটেনের কোনো পুলিশ স্টেশনেও নেই। সেখানে সহিংসতামুক্ত রাজনীতির রহস্য হল, যে পার্টিই ক্ষমতায় আরোহণ করুক না কেন তাদের দলের কারও পক্ষে বাংলাদেশের মতো অনৈতিকভাবে অর্থ সংগ্রহের সুযোগ নেই। সেখানে ভূমি দখল-পাল্টা দখল নেই। তাদের সামাজিক অভিধানে আধিপত্য বিস্তার ও মাস্তানি নেই। চাঁদাবাজি ও ডিশ অ্যান্টেনা ব্যবসার রাজ্য নেই। তাই সীমানা লঙ্ঘনজনিত সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ড নেই। ১৯৪৯ সালে দলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগে অন্তর্দলীয় কোনো সংঘর্ষ বা প্রাণহানি ঘটেনি। কারণ তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল ত্যাগের রাজনীতি। দারিদ্যপীড়িত এ দেশে বেশিরভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। সেখানে কেউ যখন গায়ে সরকারি দলের রং লাগিয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান, তখন সাধারণ মানুষ তো ক্ষুব্ধ হবেন। ধারণাতীত উন্নয়নের পরও সরকারের জনপ্রিয়তা তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অবৈধ অর্থ-সম্পদের দিকে তাকিয়ে সাধারণ মানুষের অন্তরের ক্ষোভ অনির্বাণ অনলের মতো জ্বলতে থাকে। অথচ অপরাধীরা তাদের ‘বসদের’ আশীর্বাদ ও আইনের মারপ্যাঁচে সহজে বেরিয়ে যায়। এদের দ্রুত শায়েস্তা করতে পারলে জনমত একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে যেত। এখানে প্রাপ্তির আশায় দল বদল হয়। সম্মেলনের সময় ক্ষমতাসীন দলে ব্যাপক যোগদান ঘটে। অনুপ্রবেশের স্রোতের ভেতর অস্ত্রধারী, চোরাচালানি, মজুদদার, আড়তদার, মাদকাসক্ত, অসৎ ব্যবসায়ী, নারী ও শিশু পাচারকারী, প্রত্নতত্ত্ব পাচারকারী সবাই ধান্ধা নিয়ে সরকারি দলে ঢুকে পড়ে। এসব অনুপ্রবেশ ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। কারণ তদবিরবাজি আর টাকাবাজি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়ে যায়। সরকারি দলের পরিচয় ব্যবহার করার জন্যই তারা দলে ঢুকে এবং ধরা পড়লেই সরকারি দলের পরিচয় দিয়ে থাকে। ক্ষতি হয় সরকারের।

দেশপ্রেমিক সৎ নেতাদের হাতে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া শুরু হয়েছে, যা সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ। কিন্তু কৌশলী হাইব্রিড নেতারা এদের নেতৃত্বের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। এরা পেশিশক্তিতে বলিয়ান। এরা অনৈতিকভাবে অঢেল অর্থ কামিয়ে নিয়েছে, যার বিনিময়ে সরকারি দলের বড় বড় পদবি দ্বারা নিজেদের অলঙ্কৃত করেছে। এরা অর্থ, খুঁটি ও সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে বলিয়ান হয়ে স্বগোত্রীয় হাইব্রিডদের দলে ঢুকিয়ে অনুগত কর্র্র্মীবাহিনী গঠন করে নিয়েছে। অনুগত কর্র্মীবাহিনী ও হাইব্রিড নেতারা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বন্ধনে আবদ্ধ। কথায় আছে, কানার মনে মনে জানা। হাইব্রিড নেতা ও তাদের অনুগত কর্মীবাহিনীর কাজই হল সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করা। তারা চাঁদাবাজিসহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এরা একদিকে সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করছে, অন্যদিকে গায়ে সরকারি দলের রং দেখিয়ে থানা পুলিশের সহযোগিতা আদায় করছে। অর্থাৎ রথ দেখা ও কলা বেচা দুটোই তারা করে নিচ্ছে। এদের চালাকি ধরতে হবে। এক নেতা ধরা পড়লে চেইন অব কমান্ড থেকে আরেকজন শূন্যস্থান পূরণ করে নেয়। সম্মেলন ঘনিয়ে আসছে, তাই এরা দলের ত্যাগীদের দাবিয়ে রাখতে চাইছে। হাইব্রিড নেতারা যাতে স্বপদে বহাল থাকে তা নিশ্চিত করতে সেটা করা হচ্ছে।

অস্ত্র প্রদর্শনকারী নেতাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনগত ববস্থা নিতে হবে। এসব নেতা খুনোখুনি করে হলেও পদ আঁকড়ে রাখতে চায়। তার মানে পদগুলো তাদের কাছে লাভজনক। কোনো ত্যাগী নেতা সেটা করবে না। অস্ত্রের মহড়া করে তারা হিংস্রতার প্রদর্শনী করছে যাতে তাদের হাঁকানো অঙ্ক অনুযায়ী ভয়ার্ত মানুষ চাঁদা দেয়। এ মধ্যযুগীয় কর্মকাণ্ড দলকে অপ্রিয় করছে। এরা সরকারের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে এবং জনগণের মনে উন্নয়নের যে ছাপ পড়ে সেটা মুছে দেয়। সাম্প্রতিককালের অভিযানে হাইব্রিড নেতাদের বহুমাত্রিক অপরাধের কাহিনী আবিষ্কৃত হয়েছে। তাদের দাপটে ত্যাগীরা কোণঠাসা ও নিষ্ক্রিয়। ত্যাগী নেতারা ভেতরের ও বাইরের উভয় সন্ত্রাসীদের টার্গেট। যেমন অত্যন্ত ত্যাগী নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা এমপি আহসানউল্লাহ মাস্টার প্রতিপক্ষ মাদক কারবারিদের হাতে নিহত হন। এছাড়া টাঙ্গাইলের আরেক ত্যাগী নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক নিজ দলীয় মাদক কারবারিদের হাতে নিহত হয়েছেন। অথচ ছাত্র, যুবক ও দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে মাদক নির্মূল অত্যাবশ্যকীয়। কাজেই মাদক কারবারিদের পরাজিত করতেই হবে। উদ্বেগের বিষয় হল, হাইব্রিড নেতাদের চাপে দেশপ্রেমিক নেতারা বনসাই নেতায় পরিণত হয়ে পড়েন।

কাজেই দেশপ্রেমিক নেতাদের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানোর জন্য হাইব্রিড নেতা ও তাদের অনুগত কর্র্র্মীবাহিনীকে নিষ্ক্রিয়করাসহ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া অন্তর্দলীয় সংঘর্ষ ও প্রাণহানি বন্ধ করার জন্যও তা অত্যাবশ্যকীয়; কিন্তু কাজটি কঠিন। এদের সহজে বের করা যায় না। যেমন বের করা যায়নি খন্দকার মোশতাককে। এখন বের করা যাচ্ছে না অনেক চিহ্নিত হাইব্রিডদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই

আত্মীয়তার কানেকশন ও আর্থিক কানেকশনের জন্য বাদ দেয়া যায় না। একই কারণে দীর্ঘ ৪৮ বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। দায়িত্বশীল নেতা বানানোর জন্য ‘এ’ গ্রেডের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বোঝা যায়, নেতা তৈরির উৎস রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এতে ডিফেক্টিভ প্রোডাক্টের সংখ্যা কমে যাবে। কাজেই গুণগত মানের নেতা তৈরির স্বার্থে দলের হাইব্রিড কালচার দূরীভূত করতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে হাইব্রিডদের কারও হাতে নেতৃত্ব গেলে নতুন মোশতাক তৈরি হতে পারে।

অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুল মজিদ ভূঁইয়া : সাবেক পরিচালক, প্রশাসন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়