রবিবার , ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ | ৩০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

দ্রব্যমূল্য কেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে

Paris
ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯ ১:১৬ অপরাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

চাহিদা আমলে নিয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং ক্রয়ক্ষমতাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে দ্রব্যমূল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। চাহিদার হিসাব সঠিক থাকলে, সে অনুযায়ী যথাসময়ে সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে পারলে আর ক্রয়ক্ষমতা সঠিক নজরদারিতে থাকলে বা রাখতে পারলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল হতে পারে।

বলা বাহুল্য, দেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নীতি-নিয়মের মধ্যে রাখা বা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনো কার্যকর পদ্ধতি বা ব্যবস্থা নেই। যদিও পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বেশকিছু উদ্যোগ কিংবা পদক্ষেপ প্রায় শেষপ্রান্তে এসে গ্রহণ করার ঘোষণা মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। কিন্তু পেঁয়াজের ‘বিমান ভ্রমণে’র উদ্যোগ নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়নি। আমদানি শুল্ক ও বিমানের মাশুল মাফ করে পেঁয়াজকে মহিমান্বিত করা হয়েছে, মনে হয়েছে এ কথিত কৃত্রিম সংকট অ-আমদানিকারক সিন্ডিকেটের সুযোগ সৃষ্টির কৌশল। যেমন- মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি একটি ঐতিহাসিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পেঁয়াজ, লবণ, চাল সংকট সৃষ্টিতে মনে হয় যেন এ সমস্যাকে রমজান মাসের বাইরেও সম্প্রসারণের মহড়া চলছে। রমজান মাস শুরু হওয়ার মাস দুই আগে থেকেই সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে বিশেষ কয়েকটি আইটেমের বিকল্প আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে থাকে। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও চলে সংলাপ। তারপরও রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। অতীতে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে শুধু বেগুনের মতো একটি আইটেমের মেগা দরবৃদ্ধির বিরুদ্ধেও কমিটি গঠন করে পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ভেজাল ও ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়ার পরও জনস্বাস্থ্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

একদিকে চাল, চিনি, মাছ, মাংস, ভোজ্যতেল আর সবজি এবং অন্যদিকে ছোলা, ডাল ও পেঁয়াজের মতো আইটেমের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির কারণ হল এসব পণ্যের সরবরাহের তুলনায় অস্বাভাবিক চাহিদা বৃদ্ধি। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় কোনো কোনো ক্রেতা হয়তো এসব সামগ্রী ক্রয়ে হিমশিম খান। কিন্তু অস্বাভাবিক অর্থ উপার্জনকারী পণ্যের দাম যতই হোক না কেন, তা ক্রয়ে সক্ষম। অবস্থা যদি এমন হতো যে, দাম বাড়ার কারণে সব ভোক্তা ওই পণ্য ক্রয়ে একসঙ্গে বিরত থাকতে পারেন, তাহলে সহসা সার্বিক চাহিদা কমে পচনশীল এসব পণ্যের দাম পড়ে যেত। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, কারণ সেক্ষেত্রে উৎপাদন এবং এর বিপণন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এর ফলে সরবরাহ চেইনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অর্থনীতি এভাবে চলতে পারে না। চড়া মূল্যে কেনার মানুষ আছে বলেই চড়া মূল্য হাঁকা হয় আর এ পর্যায়ে স্থির কিংবা সীমিত আয়ের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বোঝার বাকি থাকে না, এমতাবস্থায় চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বিচ্যুত হয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

মানুষের মধ্যে অস্বাভাবিক অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয় বিশেষ বিশেষ সময়ের প্রয়োজনে এবং সে প্রয়োজন মেটাতে হয় ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। ক্রয়ের সক্ষমতা সব পর্যায়ে সমানভাবে বৃদ্ধি না পেলে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।

ফরমালিনের বিরুদ্ধে জোরেশোরে অভিযান চললেও পরিস্থিতির আশাজাগানিয়া কোনো উন্নতি ঘটেছে কি? ফরমালিন ব্যবহারকারীরা আপাতত পিছু হটলেও খাদ্যদ্রব্যে অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সমানে চলছে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ফরমালিন বা বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার এবং শেষমেশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের অহেতুক বৃদ্ধিকে অধিক মুনাফা অর্জনের অসৎ মানসিকতাপ্রসূত এক ধরনের ‘জুলুম’ বলে অভিহিত করা যায়। পণ্যে ভেজাল দেয়া বা ফরমালিনসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যে পরিবেশ ও আর্থ-প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এটা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, সে ব্যবস্থায় দায়িত্বশীলরা এর দায় এড়াতে পারেন না। এসব অন্যায়-অনিয়মের উৎস বন্ধ না করে অন্যায়-অনিয়ম সংগঠিত হওয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা যুক্তিযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে না। যেমন- দুর্নীতি দমনের কাজ দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার পর শুরু করার মানে হল নিহত ব্যক্তির পোস্টমর্টেম করা মাত্র। ক্ষতি যা হওয়ার তা হওয়ার পর দুঃখ ও বেদনার মাত্রা নির্ণয় করা। এসবের অবসানে সমস্যার উৎস পর্যায় থেকেই জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। সমস্যার গভীরে না গিয়ে প্রতিবিধানের চেষ্টা করা হলে দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।

নকল, ভেজাল ও মুনাফা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুশাসনের বিষয়টি অনেকেরই অজানা, আবার যাদের জানা তারা না-জানার ভান করেন। বিষয়গুলো সবার সজ্ঞান মানসিকতায় আনা দরকার। অধিক মুনাফা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা, অপব্যয়, অপচয়, আত্মসাতের প্রবণতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সার্বিকভাবে সব পক্ষের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। মানসিকতা পরিবর্তনে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা এসব নিয়মকানুন প্রয়োগ ও প্রতিপালন পরিবীক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদেরও যথাযথ দায়িত্ব পালনে সজাগ ও সক্রিয় হতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও দেখভালের দায়িত্ব পালনকারীরা নিজেরাই যেন ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে না দাঁড়ান, সেদিকে সবার সতর্ক থাকা দরকার।

উদাহরণস্বরূপ, বিগত সময়ে রমজানে ডালের মূল্যবৃদ্ধির কার্যকারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়- একটি পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল- ‘রমজানে দেশে ডালের চাহিদা ১ লাখ ৪০ হাজার টন। আর মজুদ আছে ৪ লাখ টন, যা দিয়ে সারা বছরের চাহিদা পূরণ সম্ভব। তারপরও রোজার শুরুতেই বেড়েছে সব ধরনের ডালের দাম। এজন্য সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। আবার পাইকাররা দুষছেন ব্যবসায়ী ও আবহাওয়াকে। পেঁয়াজু, হালিমসহ বিভিন্ন খাবারে ডালের বহুল ব্যবহারের কারণে প্রতিবার রমজানে মসুর, মুগ, অ্যাংকর ও খেসারির চাহিদা বাড়ে। চাহিদা বৃদ্ধির এ সুযোগে দামও বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে প্রতি কেজি দেশি মসুর ৫ টাকা, আমদানি মসুর ৪, অ্যাংকর ২, মুগ ৩ ও খেসারি ডালের দাম ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, কয়েক দিন বাড়তি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। ফলে বাজারে কিছুটা সংকট চলছে, যার প্রভাবে বাড়ছে দাম। পাশাপাশি কিছু মিল মালিক বৃষ্টি ও আবহাওয়া খারাপ থাকার অজুহাত দিচ্ছেন। আর আমদানিকারকরা বলছেন, গত বছর লোকসানের পর এবার আমদানি কম হওয়ায় সরবরাহ কমেছে বাজারে। পরস্পরের ওপর এমন দোষারোপের সংস্কৃতি এবং ব্যবসায়ীদের খোঁড়া যুক্তির কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের সব প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়। এমনকি ফুটপাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ক্ষুদ্র কেনাবেচার ক্ষেত্রে যে চাঁদাবাজি চলে, তার পরিমাণও কয়েকশ’ কোটি টাকা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে এসব ‘বিনিয়োগ ছাড়াই অর্থ উপার্জনের’ মতো কর্মকাণ্ড প্রভাবক ভূমিকা রাখছে।

দুনিয়ার সব দেশে উৎসব বা পার্বণ উপলক্ষে সরবরাহের ব্যাপকতায় দ্রব্যমূল্য প্রতিযোগিতামূলক হয়ে যখন সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে, তখন বাংলাদেশে ঘটে ঠিক এর উল্টোটা। ঈদ উৎসবকে উপলক্ষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দেশের ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাজার ব্যবস্থাপনাসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মধারায় যেসব সমস্যা সবার দৃষ্টিসীমায় আসে সেগুলোর সুরাহা কিংবা প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানের ব্যাপারে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

সর্বশেষ - মতামত