অস্তিত্ব সংকটের মুখে ১৪ দলীয় জোট

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

দেশে রাজনৈতিক মেরুকরণের এক জটিল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ১৪ দলীয় জোট। তখন এর কার্যকারিতা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেরই অংশ হয়ে থাকবে। এরপর ভাঙা-গড়ার মধ্যে প্রায় দুই দশক ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছে ১৪ দল। তবে বর্তমানে বড় সংকটের মুখে পড়েছে এ জোট।

পরপর দুটি সংসদ নির্বাচনে আশানূরূপ আসন না পাওয়া এবং জোটগত সহযোগিতার অভাবে শরিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন-উত্তর সরকার গঠনেও দ্বিতীয়বারের মতো বঞ্চিত হন তারা। এমন কি, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সরকারপ্রধানকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগও হয়নি জোটের পক্ষ থেকে।

এ অবস্থায় শরিক দলগুলোর নেতারা যে যার মতো আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। কেউ কেউ আলাদা প্ল্যাটফর্ম গঠনের বিষয়েও ভাবছেন। তবে ১৪ দলের বর্তমান সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাইল্যান্ড সফর শেষে দেশে ফিরলেই তাদের নিয়ে বসা হবে।’

গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জোটের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই সভায় তিনি শরিকদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ইঙ্গিত দেন। প্রতিটি শরিক দলকে শক্তিশালী করে মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর বিষয়েও ইঙ্গিত দেন। ওই দিন সভা থেকে বলা হয়েছিল, ১৪ দল ছিল এবং থাকবে। তবে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে জোটের নেতাকর্মীদের অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে জোটের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে।

গত বুধবার রাজধানীর শাহবাগে টেনিস কমপ্লেক্সে প্রয়াত রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ছিলেন ১৪ দলের শরিক দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। সূত্র জানায়, ওই সভায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই ছিলেন। তারা ১৪ দলের বাইরে আলাদা একটি রাজনৈতিক মোর্চা করারও প্রস্তাব করেন।

গত সপ্তাহে ১৪ দলের শরিক তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিল। ওই অনুষ্ঠানে ১৪ দলের সমন্বয়কসহ জোটের নেতারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। ওইদিনও জোটের সংকট নিয়ে নেতারা কথা বলেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাদের ভাষ্য, বিএনপি-জামায়াত সেভাবে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে না। শুধু প্রেস রিলিজ আর সংবাদ সম্মেলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। ফলে দেশে এখন বিরোধী রাজনীতির সংকট আছে। তাই সে অর্থে এখন ১৪ দলের শরিকদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ভাঙনের দিকে যাচ্ছে না আওয়ামী লীগ, জোটের শরিকদের থাকতেও বলা হচ্ছে না। যেতেও বলা হচ্ছে না।

আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতার ভাষ্য, জোটের শরিকদের বারবার বলা হয়েছে তাদের দলকে গোছাতে; কিন্তু জোট সরকার টানা চারবার ক্ষমতায় আসার পর শরিকরা দলের তুলনায় ব্যক্তি উন্নয়ন বেশি করেছেন। ফলে দলগুলোও আগের তুলনায় দুর্বল অবস্থায় আছে। কোনো কোনো দলে ভাঙন হয়েছে। সুতরাং তারা জোটে এখন থেকেই বা কী লাভ।

জোটের শিথিলতার বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সঙ্গে। প্রশ্ন করতেই তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘১৪ দলের কোনো খবর নেই। ১৪ দল শেষ।’ এ বিষয়ে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা এখনো মনে করি জোটের প্রয়োজন আছে। তবে যারা জোটের নিয়ামক শক্তি, তারা যদি এটা ফিল করত তাহলে ফাংশন করত। তারা তো ফিল করছে না।’

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ থেকে সরে গিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জাসদ গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ জাসদ ১৪ দলে থেকে চাওয়ার-পাওয়ার হিসাব না মেলায় জোট ছেড়েছে। হাসানুল হক ইনু নেতৃত্বাধীন জাসদ ১৪ দলের সঙ্গে রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন। এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। যদিও জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেন, ‘যতদিন মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ থাকবে, ততদিন এই জোট চলবে।’

জোটের শরিক কমিউনিস্ট কেন্দ্রের নেতা ডা. অসিত বরণ রায় বলেন, ‘১৪ দল নিভু নিভু হয়ে আছে। এটি আছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। নির্বাচনের পরে বৈঠক হওয়ার কথা, তাও হচ্ছে না। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীকে একটা শুভেচ্ছা জানানোর বিষয় ছিল, সেটারও সুযোগ হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আরেকটা প্রগতিশীল জোটের বিষয়ে ভাবছি। পঙ্কজ ভট্টাচার্যের স্মরণসভাতেও আমরা এ বিষয়ে আলাপ করেছি।’ জোটের শরিক বাসদ নেতা রেজাউর রশীদ খান বলেন, ‘১৪ দল নামে আছে, কামে নাই।’

উল্লেখ্য, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ দল গঠন করা হয়। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ ২৩ দফা কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিয়ে এই জোট যাত্রা শুরু করে। একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকারও ছিল তাদের। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারে জোট শরিকদের কয়েকটি মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ অনেকটাই ‘একলা চল’ নীতি নিয়ে চলছে। ফলে ২০১৯ সালে তৃতীয় দফায় গঠিত সরকারের পর এবার চতুর্থ মেয়াদের সরকারের মন্ত্রিপরিষদে শরিক দলের কোনো নেতার ঠাঁই হয়নি।