অস্ট্রেলিয়ার ক’খানা দিন

যুবায়ের হাসান:

গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি এক গভীর রাত । ঘণ্টার কাঁটা সবে পয়লা নম্বর ছুঁয়েছে । পরিবার সমেত আমার পুরো শরীরও তখন ঢাকার আকাশে উড়েছে । শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে উড়াল দিল মালয় এয়ারলাইন্সের সুপরিসর বিমানখানা । প্রবাসী ভাইদের ডাকে চলেছি অস্ট্রেলিয়ার পথে । ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর পর্যন্ত টানা চারঘণ্টার উড়ান । বিমান বদলে দু’ঘণ্টা বাদে শুরু হলো আমাদের সিডনি যাত্রা ।

 

এবারে পাক্কা আটঘণ্টার উড়ান । একটানা এতো লম্বা আকাশভ্রমণ আগে কখনো করিনি, কিন্তু সমস্যা হলো না, আকাশের নীল আর ভারত মহাসাগরের গভীর নীলের মাখামাখি দেখতে মন্দ লাগছিল না–এ যেন ওপরেও আকাশ, নিচেও আরেক আকাশ ! আকাশপরিদের দেয়া ভিন্ন স্বাদের খাবার সামনে নিয়ে, নিজ মনিটরে ইচ্ছা মতন সিনেমাদেখা বা গানশোনার সুযোগ কাজে লাগালাম । আর এ ভাবেই কেটে গেল চারঘণ্টা ।

 

ব্রুমিং নামের ছোট্ট এক বন্দরের পাশ দিয়ে আমরা অস্ট্রেলিয়ার আকাশে ঢুকে পড়লাম । তখন মাঝদুপুর, কিন্তু বাইরের তাপমাত্রা হিমাংকের পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড নিচে আর বিমানের গতিবেগ ঘণ্টায় নয়শো কিলোমিটারের কাছাকাছি । এর মানে, একবার এখান থেকে ছিটকে পড়লে, মুহূর্তেই ঠাণ্ডা বরফখণ্ড বনে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে । বালাই সাট, এ সব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে নিচে তাকালাম ।

 

বাব্বা, এ যে মরা মাটির দিকচিহ্নহীন প্রান্তর ! মরুভূমির বিপুল বিস্তার । শেষ হতে চায় না । আর হবেই না বা কেন? আমাদের দেশের প্রায় পঞ্চাশ গুণ আয়তনের এ এক প্রকাণ্ড দেশ । নানা বৈচিত্র্য আর আকর্ষণ নিয়ে সে সেজে বসে আছে । বাকি চারঘন্টা তাই খারাপ কাটল না । শেষের দিকে এসে, সবুজের দেখা মিলল । তবে এরই মধ্যে সূর্য গা-ঢাকা দিয়েছে, শেষপর্যন্ত সন্ধ্যার ঘনায়মান আঁধার চিরে আমরা আলোর তীর্থ সিডনিতে এসে নামলাম । আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আমার তিন ভাই আর ওদের পুরো পারিবারিক বাহিনীর সংগে দেখা হয়ে গেল ।

13077394_925728100830006_673686763_n

সে এক মধুর মিলন ! কিছু সময়ের জন্য সবাই আমরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লাম । এরপর দলেবলে আস্তানার দিকে রওনা দিলাম । পরদিন শুরু হল লাগাতার ঘোরাঘুরি । সব আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল, শুধু সে-মোতাবেক চলা আর কি । দিগন্তছোঁয়া মাঠ আর মাঠ, বন-পাহাড়-পার্কের সীমাহীন সমাবেশ । পটাসবাবু, মানে ইউক্যালিপটাস গাছের বিপুল আধিক্য–এ দেশ যে এ গাছ আর এ্যাকাশিয়ার মাতৃভূমি । আছে নানা জাতের চেনা-অচেনা গাছ, তবে পাতায় সবুজের গভীরতা একটু কমই । দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান এই মহাদেশের । সে-কারণে আমাদের বিপরীত ঋতুবৈচিত্র্য । জুন-জুলাইয়ের তীব্র এক শীতকাল কাটিয়ে সবে বসন্ত শুরু হয়েছে, তবে শীতের প্রকোপ কমেনি ।

 

শেষের দিকে এসে, দাবদাহ কাকে বলে, সে-ও টের পেলাম । যাই হোক, যেখানেই রাত কাটাই না কেন, ঘুম ভেঙেছে এ দেশি কোকিলের কুহুতানে । সেই একই কণ্ঠশৈলী–আমাদের এখানকার সংগে কোন তফাৎ নেই । থাকত আরও নানা জাতের পাখির কিচির-মিচির । শালিখ, ঘুঘু, টিয়া দেখেছি বেশুমার । সাগর উপকূল ছাড়িয়ে অনেক ভেতরেরও দেখেছি সি-গালের সদম্ভ উপস্থিতি । সত্যি কথা বলতে কি, এই নিরিবিলি, হালকা লোকবসতির দেশটা পাখি আর জীবজন্তুর বিশাল এক উপনিবেশ হয়ে উঠেছে । সবখানেই এদের সাহসী চলাফেরা । পৃথিবীর বিরল প্রজাতির শতকরা আশিভাগ কীটপতঙ্গ এখানে বসতি পেতেছে । ক্যাংগারু, কোয়ালার মতন বিচিত্র প্রাণী এই মহাদেশের অনন্য ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে । শুধু পাখি বা প্রাণীই বা বলি কেন, এ দেশ একই সংগে ফুলের দেশ, বাগানের দেশ, শিশুদের দেশ।

 

এ দেশে এদের কদর চোখে পড়ার মতন । সবকিছুই সাজানো, পদ্ধতির ছাঁচে পড়েও সুন্দর । সরকারী, বেসরকারী ব্যবস্থাপনা আর সর্বসাধারণের মানসিকতা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে শিল্পোন্নয়নের চরম শিখরে, খুব আশ্চর্যের বিষয়, পাশাপাশি তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক আর সামাজিক নিরাপত্তার এক সুস্থ বাতাবরণ । এ দেশে কেউ না-খেয়ে বা অভাবে পড়ে কষ্ট পায় না । ধনীদের আয় বা বেতন থেকে উচ্চহারে মাসিক ভিত্তিতে টাকা কেটে নিয়ে, সে-টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে স্বল্প আয়ের লোকেদের জন্য । চালু আছে নানা রকমের সামাজিক উদ্যোগ আর কর্মকাণ্ড । বেকার ভাতা, শিশুভাতা, অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা–এরই এক একটা সুফল । মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য ব্যাপক নয় ।

 

সবাই হয়েছে তাই গাড়ি, বাড়ির মালিক । জীবন ধারণের মৌলিক খাবারের দাম অস্বাভাবিক রকম কম–সম্ভবত এতে ভর্তুকির ব্যবস্থা বহাল আছে । মোটামুটি যা বুঝেছি, তাতে সবাই সুখী । মনে হয়েছে, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্রের মূল বিষয়টা এরা এদের আর্থসামাজিক কাঠামোতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিয়েছে, বাস্তবায়ন করেছে রাষ্ট্রীয় জীবনে, তাই নতুন করে সমাজ বদলানোর বিপ্লবের কোন প্রয়োজনই এখানে নেই । প্রথম কদিন সিডনি মহানগরীর বড় বড় সব জায়গা দেখে কাটালাম । দুনিয়াখ্যাত অপেরা হাউজ, হারবার ব্রীজ সিটি সেন্টারে, একদম পাশাপাশি । এ বলে ওকে দেখ, ও বলে একে দেখ অবস্থা । অলিম্পিক স্টেডিয়াম, মাদা্ম তুসর মিজিয়াম, ওসান পার্ক, চিড়িয়াখানার মতো অজস্র দ্রষ্টব্য । আর আছে বেশ কখানা বিচ–মহাসাগরলাগোয়া সুন্দর সৈকত । এদের মধ্যে বন্দাই, ম্যানলি বিচের অনেক নামডাক । সিডনির বাইরে প্রথম গন্তব্য ছিল ব্লু মাউন্টেনের জেনোলান সুড়ঙ্গ ।

 

এটা এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন এক প্রাকৃতিক নিদর্শন । বয়সে ৪০ কোটি বছর । বেশ কটা পাথুরে পাহাড়ের মাঝে গোটা সাতেক প্রসস্থ সুড়ঙ্গ । চড়াই উতরাইয়ের লম্বা পথ । পুরোটাই চলার সুবিধার জন্য আলোকিত । চলতে চলতে উত্তেজনায় হাত-পা কেঁপে ওঠে । চোখে জাগে বিস্ময়ের ঘোর । কমলা রুখু পাথরকে ছুঁয়ে কোটি বছরকে খুঁজে পাওয়ার স্বাদ পাওয়া যায় । ফেরার পথে পরিচয় হলো ‘থ্রি সিস্টার্স’ নামের তিন প্রাচীন পাথুরে পাহাড়ের সংগে । হাইওয়ের পাশেই এরা দিকচিহ্নহীন মাঠের মাঝে পাশাপাশি শুয়ে । এরও বয়স অনেক কোটি বছর । অনেক উপকথা চালু আছে এই তিন বোনকে নিয়ে । এরপরের দিন আমরা গেলাম সিডনি পেরিয়ে আরেক দিকে । উলনগং বন্দর পেরিয়ে নানটিন বৌদ্ধ একাডেমীতে । বিশাল এলাকা নিয়ে এক শান্ত নির্জন এলাকা । অতিকায় দুটি মন্দির, ঘন সবুজ বনানি । মনটা তাই এমনিতেই এক অপার শান্তিতে ভরে ওঠে । অন্য আরেকদিন গেলাম ক্যানবেরায় । সেও গাড়ীপথে । এর পরিচয় পুরো অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী হিসেবে ।

13081932_925728177496665_859857256_n

পাহাড়ে ঘেরা, সবুজে ছাওয়া এই খুব সাজানো শহরটার তুলনাই হয় না । গাছের ছায়ায়, ফুলের বাগানে ঢাকা এমন সাজানো নিরিবিলি নগর খুব কমই দেখা যায় । উচ্চতার কারণে ঠাণ্ডাটা একটু বেশিই । গোরা সাহেবদের জন্য খুব মানানসই এক বসতি এই ক্যানবেরা । মেলবোর্নের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া । বেশ কবছর ধরে সেরা নগরগুলোর তালিকার মাথার ওপরে এর অবস্থান । সৌন্দর্য আর নাগরিক পরিসেবায় তুলনাহীন । দেখার ইচ্ছা তাই আগে থেকেই ছিল, কিন্তু সে আবার ৮০০ কিলোমিটারের দূরের ব্যাপার । সময় বাঁচাতে তাই বিমানে করে একদিন গেলাম । যা যা শুনেছি বা পড়েছি, ঠিক তেমনই সুন্দর আর ঝকঝকে ।

 

সোনার সন্ধানে এখানেই প্রথম বসতি গেড়েছিল বেনিয়া ইংরেজরা । এরপরের ইতিহাস তো সবারই প্রায় জানা । দক্ষিণ মহাসাগরের উপকূল বেয়ে তৈরি হয়েছে ওসান মেরিন ড্রাইভ ওয়ে। কী অপরূপ নিসর্গ বুকে নিয়ে যে এই সুদীর্ঘ পথখানা তা বলার ভাষা আমার জানা নেই । কিছু তথ্য : ল্যাটিন শব্দ Terra Australis, মানে ‘দক্ষিণ অঞ্চল’ থেকেচস্ট্রেলিয়া নামের উৎপত্তি । আয়তনে অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর ছয় নম্বর বৃহত্তম দেশ । 

 

ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন জেমস কুক ১৭৭০ সালে সিডনিতে সভ্য পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসাবে পদার্পণ করেন । বিশ্ব অর্থনীতিতে এ দেশের অবস্থান ১২ নম্বরে । মাথাপিছু আয়ে অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর পঞ্চম দেশ । মানব সূচক উন্নয়নের হারে বিশ্বে সুইজারল্যান্ডের পরেই এ দেশের অবস্থান ।

স/আর