অটোরিকশায় চড়ে জুলুম হজমের গল্প

চিকিৎসকের কাছে যাব। গন্তব্য পূর্ব তেজতুরী বাজার থেকে ধানমন্ডি।

সাক্ষাতের সময় সন্ধ্যা। প্রধান সড়ক পার হয়ে রিকশায় যাওয়ার উপায় নেই। যেতে হবে সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। এই সেরেছে!

চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে মন-মেজাজ স্থির রাখা জরুরি। কিন্তু অটোরিকশায় উঠতে গেলে তা সম্ভব হবে কি না, ভেবে কপালে ভাঁজ।

এত শত ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা নামে। হাতে একেবারে সময় নেই। সহকারীকে দ্রুত অটোরিকশা ডাকতে বলি।

সহকারী গ্রাম থেকে আসা ছেলেমানুষ। ঢাকা শহরের হাবভাব এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। আর অটোরিকশাচালকদের মতিগতি বোঝা তো আরও অনেক পরের কথা।

মিনিট কয়েক ধরে সহকারীকে পইপই করে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। অটোরিকশা ঠিক করার কৌশলও শিখিয়ে দিলাম। সহকারী রওনা দেয়। আমি বাড়ির সামনে অপেক্ষায় থাকি।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কাঁচা ছেলে। অটোরিকশাচালকদের সঙ্গে দর-কষাকষির কাজটা হয়তো ঠিকমতো পারবে না। আর অটোরিকশা আনতে পারলেও পকেটকাটা ভাড়া যাবে।

১০ মিনিটের মাথায় অটোরিকশা আসে। কথা না বাড়িয়ে উঠে বসি। মনে মনে বলি, এই সময়ে ভাড়া নিয়ে ভাবতে গেলে আজ চিকিৎসক দেখানোর সূচিটাই ছুটে যেতে পারে।

চলতি পথে সহকারী বলে, ‘আমরা মিটারে যাচ্ছি।’

পুরাই তাজ্জব বনে যাই। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। সহকারীর কাছে জানতে চাই, মিটারে ওঠা ভাড়ার অতিরিক্ত কত দিতে হবে?

‘এক টাকাও না’ বলে জবাব আসে।

এমন অটোরিকশাচালকও ঢাকায় আছেন ভেবে বিস্মিত হই। গত সাত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মিটারের ভাড়ায় এক দিনও গন্তব্যে যেতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না। এই সময়ে ভাড়ার বিষয়ে অটোরিকশাচালকদের একটা সাধারণ প্রবণতা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি।

প্রবণতাটা অনেকটা এমন—
‘রোদ চড়েছে, ভাড়া বাড়ায়ে দিতে হবে।’
‘বৃষ্টি হচ্ছে, ভাড়া বেশি পড়বে।’
‘পরিবেশ ম্যাড়ম্যাড়ে, বেশি না দিলে যামু না।’
‘যাত্রী বেশি, আইজ ভাড়া বেশি।’
‘যাত্রী নাই, ভাড়া বাড়ায়ে দিয়েন ভাই।’

মোদ্দা কথা, আকাশ-বাতাসের পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, অটোরিকশায় মিটারে যাওয়ার কায়দা নেই। অতিরিক্ত ভাড়া দিতে রাজি হয়েও যাত্রীর বিড়ম্বনার শেষ নেই। গন্তব্যে রওনার আগে ‘শর্ত প্রযোজ্য’ হিসেবে অটোরিকশাচালকেরা বলে বসেন, ‘ট্র্যাফিক ধরলে মিটারের কতা কইবেন কিন্তু।’

যাত্রী অসহায়। গন্তব্যে যেতেই হবে। বাধ্য হয়ে মিথ্যা বলার প্রতিশ্রুতি কবুল করতে হয়।

অতীতের সঙ্গে এবার অটোরিকশায় চলার অভিজ্ঞতা একেবারেই মেলে না। মনে কৌতূহল জাগে। কথা বলি চালকের সঙ্গে। নাম আয়নাল। বাড়ি গাইবান্ধায়। থাকেন ঢাকার মধুবাগে।

গন্তব্যের কাছাকাছি সিগন্যালে অটোরিকশা থামে। এই সুযোগে প্রশ্ন করি, ‘এখন তো কেউ মিটারে চলতেই চায় না। আপনি ক্যামনে চলেন?’

পেছন ফিরে একটু হাসেন আয়নাল। খানিক পরে বলেন, ‘চাইলেই চলা যায়। ন্যায্য ভাড়ার বেশি নিয়া মানুষ ঠকাই ক্যামনে।’

গন্তব্যে পৌঁছে মিটারে ওঠা ভাড়া চুকাই। আয়নালকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিই। মনে একটা ভালো লাগার রেশ রয়ে যায়।

ফুরফুরে মেজাজে চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব শেষ হয়। এবার বাসায় ফেরার পালা। ফিরতি যাত্রার অটোরিকশা ঠিক করা হলো। এবারের চালকও মিটারে যেতে রাজি। অটোরিকশায় বসে ভাবি, ব্যাপার কী! নিয়মের মধ্যে সব চলে এল নাকি!

বাসার সামনে অটোরিকশা এসে থামে। ভাড়া দেওয়ার আগেই চালক বলে উঠলেন, ‘মিটারে আইছি ঠিক আছে। তয়, ভাড়া বেশি দিতে হইব। মিটারের চেয়ে ১০০ টেকা বেশি দেবেন। সবাই দেয়।’

অন্যায্য দাবিতে অনড় চালকের কণ্ঠ ক্রমেই রূঢ় হতে থাকে। কথার তুবড়ি ছোটে। এ অবস্থায় ব্যতিক্রমী চালক আয়নালের কথা মনে পড়ল। অন্তত তাঁর কথা ভেবে ঝামেলায় মন টানছিল না। অবশেষে চোখ বুঝে জুলুমটা হজম করে ঘরে ঢুকলাম। অন্য ক্ষেত্রে হলে মন খচখচ করত। কিন্তু অটোরিকশাচালকদের জুলুমের ব্যাপারটা ভিন্ন। অভ্যাস থাকায় সহজেই এই জুলুম হজম করা গেছে।

সূত্র: প্রথম আলো