দুর্গাপুরে খালের মুখে বিএনপি নেতা ও ডাক্তারের পুকুর: ৩০০ একর জমির ফসল নষ্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার দুটি বিলে খালের মুখে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করার কারণে প্রায় ৩০০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো বিল থেকে পানি সরে যায়নি। ফলে এ মৌসুমে ওই জমিতে আলু চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে চাষিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে তিন দফা অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাননি। এখন তারা মাঠে গিয়ে শুধুই আহাজারি করছেন।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আক্তারুন্নাহার জানান, প্রতিনিয়ত পুকুর নিয়ে তাদের কাছে অভিযোগ আসছে। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন হচ্ছে। এ বিষয়ে তারা খুবই তৎপর রয়েছেন। তারা বিলের পানি নিষ্কাশনের বিষয়টি দেখবেন।
এই উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের অনুলিয়ার বিল ও পোড়াবিলে ধান, পান, মরিচ, আলু, লাউসহ সব ধরণের সবজি চাষ হয়। বর্ষায় বিলের পানি একটি সরকারি খাল দিয়ে বারনই নদীতে নেমে যায়। এ জন্য তাদের ফসলের কোনো ক্ষতি হয় না।

 

চাষিরা জানান, গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে এই বিলে পুকুর খননের হিড়িক পড়ে গেছে। পুকুর মালিকেরা সাধারণ চাষিদের বাধ্য করছেন জমি বিক্রি করতে। এমনকি জোর করেও জমি দখলে নেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চাষিদের অভিযোগ, বিশেষ করে রাজশাহী লাইয়নস চক্ষু হাসাপাতালের সাবেক চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম ওরফে লিটন ডাক্তার ও দেলোয়াবাড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির নেতা গোলাম সাকলাইনের পুকুরের কারণে খালে আর পানি যেতে পারছে না। শফিকুল ইসলাম প্রায় ৮০ বিঘা জমিতে এবং সাকলাইন চেয়ারম্যান ৪৫ বিঘা জমির ওপরে এমনভাবে পুকুর খনন করেছেন তাতে পানি খালে নামার রাস্তা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
ওই বিলে গিয়ে দেখা যায়, জলাবদ্ধতার কারণে মরিচের খেত, পানের বরজ, পেয়ারা বাগান, কুমড়ার খেত সবই নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো কোনো জমি থেকে সদ্য পানি নামছে। কোনো কোনো জমিতে এখনো হাঁটুর ওপরে পানি রয়েছে। মাঠে গিয়ে শতাধিক ভুক্তভোগী চাষিকে পাওয়া যায়। তাদের সবার মুখে শুধুই আহাজারি। সবাই বলছেন, বিলের পানি নামাতে না পারলে তারা না খেয়ে মারা যাবেন।
পালশা গ্রামের চাষি আব্দুল জলিল বলেন, ‘আমার পৌনে তিন বিঘা জমিতে পান বরজ ও সবজি ছিল। জমির চারিদিকে বাঁধ দিয়ে স্যালো মেশিন দিয়ে সারারাত পানি সেচেও আমি ফসল বাঁচাতে পারিনি। পানিতে পান-সবজি সবই নষ্ট হয়ে গেছে।
একই গ্রামের মুজিবুর রহমান বলেন, তার পৌনে চার বিঘা জমিতে মরিচ ছিল। ১০০ টাকা কেজি মরিচ।  আমি এবার ২০ লাখ টাকার মরিচ বিক্রি করতে পারতাম। পানিতে সব শেষ হয়ে গেছে। খালে পানি নামানোর ব্যবস্থা না করলে আমাদের মরতে হবে।

 

বেলাল মোল্লা বলেন, ‘আমার ২২ শতাংশ জমিতে পান বরজ ছিল। কমপক্ষে চার লাখ টাকার পান বেচতে পারতাম। পানিতে সব মরে শেষ হয়ে গেছে। খুরশিদ আলম বলেন, তার ১৮ কাঠা জমিতে সাকলাইন চেয়ারম্যান জোর করে পুকুরের মাটি ফেলেছেন। এখন লোক পাঠাচ্ছেন এ জমি তার কাছে বিক্রি করতে হবে। ইসরাইলের সোয়া দুই বিঘা জমির বরবটি ও লাউ মরে গেছে। সেখানে পানি জমে রয়েছে।

 

ইসরাইল বলেন, ‘এখন আমরা এই জমিতে আলু চাষ করব কিন্তু এখনো জমিতে পানি জমে রয়েছে। কী করবে ভাবতেই পারাছি না।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, খালের থেকে খানিকটা দূরে তার পুকুর।

 

পাঁচ বছর আগে তিনি পুকুর কেটেছেন। এতদিন তার পুকুরের পাশ দিয়েই পানি খালে গিয়ে পড়ত। তাছাড়াও তিনি কিছু পাইপ দিয়েছিলেন। পাইপের ভেতর দিয়েই বিলের পানি নিষ্কাশন হতো। চেয়ারম্যান পুকুর কাটার সময় তার পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। পাশের পানি যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তিনি যখন পুকুর খনন করেছের তখন ছাড়পত্র নেওয়ার প্রয়োজন হতো না।
চেয়ারম্যান গোলাম সাকলায়েনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার দুটি ফোন নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে। শফিকুল জানান, গোলাম সাকলায়েন বর্তমানে ভারতে রয়েছেন। তবে সাকলাইনকে পুকুর খননের জন্য পৌনে তিন বিঘা জমি দিয়েছেন যুগিশো গ্রামের আব্দুল হাকিম।

 

তিনি বলেন, চেয়ারম্যান অনুমতি নিয়ে পুকুর খনন করেছেন। যেখানে করেছেন সেখানে সরকারি খাল ছিল না। তাদের জমির ওপর গিয়ে তারা পানি যেতে দেবেন না। তারা পানি পার হওয়ার যেটুকু জায়গা রেখেছিলেন চেয়াম্যান বিদেশে থেকে এলে সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, যেদিক দিয়ে খালে পানি যেত সেখানে অন্যলোক পুকুর করেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিমল কুমার প্রামাণিক জানান, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ভুমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যায় না। দুর্গাপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলায় মাছ চাষের জন্য ৫ হাজার ৭১টি পুকুর খনন করা হয়েছে।

 

এর আয়তন ২ হাজার ৯৫৪ দশমিক ৩৬ হেক্টর। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজিবুল ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসক ধানি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুর খননের অনুমতি দিতে পারেন কিন্তু তার জানামতে পুকুর খননের জন্য অনুমতির কোনো কপি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তার কাছে আসেনি।

স/আর