জনপ্রিয়তা বাড়ছে কফির

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

চা না কফি? বর্তমানে নিত্যদিনের সাধারণ এক প্রশ্ন এটি। ঘরে-বাইরে সবখানে সমানভাবে প্রচলন হয়েছে কফি পানের। কিন্তু দুই যুগ আগেও সুযোগ ছিল না চায়ের বিকল্প কিছু বেছে নেওয়ার। ২০২২ সালে এসে, এখনো চায়ের মতো পরিচিত না হলেও কফি আর ততটা অপরিচিতও নয়। চা-কে ছাড়িয়ে যেতে না পারলেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কফি।

ব্রিটিশ কফি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সারা পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় কফি। তিন বছর আগে তারা হিসাব করে দেখিয়েছে, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি কাপ কফি পান করা হয়। তবে সারা বিশ্বের হিসাবে কফি জনপ্রিয় হলেও এশিয়ায় হিসাব ভিন্ন। কারণ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশ, ভারত এবং চীনে এখনো কফির চেয়ে চা-কেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও তাই। যদিও ধারণা করা হয়, একসময় সারা বিশ্বের মতো এ অঞ্চলেও কফির জনপ্রিয়তা শীর্ষে যাবে।

বাংলাদেশে কফির অবস্থা:
এ দেশে চায়ের জনপ্রিয়তা শুরু ব্রিটিশ শাসনের শেষ ভাগে। আর কফি দুই যুগের। আবার কফি প্রচলনের শুরুটা একদম শ্লথ হলেও শেষ এক দশকে এর প্রচলন বেড়েছে বেশ। এখন ‘মাঝে-মধ্যে’ কফির স্বাদ নেন এমন অনেকে যেমন রয়েছেন, তেমনি নিয়মিত পানীয় হিসেবে চায়ের পরিবর্তে কফি পান করছেন অনেকে।

কফি বাজারজাতকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ৯০০ থেকে ১ হাজার টন কফির চাহিদা রয়েছে। এর প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আর এ বাজার বিদেশি কোম্পানিগুলোর দখলে। দেশি কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান কফির ব্যবসা শুরু করলেও তাদের মার্কেট শেয়ার কম।

jagonews24

 

তথ্য মতে, বাংলাদেশে কফির যেসব ব্র্যান্ড রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নেসলে বাংলাদেশ, নর্থ-এন্ড, লাভাজ্জা, ম্যাককফি, কফি, রোজ কফি ও ডিলাইট কফি। এর মধ্যে পুরো বাজারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দখল রয়েছে বিদেশি কোম্পানি নেসলের। বাকি এক অংশ অন্যান্য ব্র্যান্ডগুলোর।

নেসলে বাংলাদেশে কফির ব্যবসা করছে ১৯৯৪ সাল থেকে। এর আগেও ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কফি আমদানি হতো। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কফির বিপণন ও কফির প্রচারে নেসলের অবদান এখনো সবচেয়ে বেশি।

ঢাকার বিভিন্ন খাবার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য খাবারের পরে কফি খাওয়া এখন শহুরে কালচারে পরিণত হয়েছে। ফলে খাবারের দোকান চালাতে গেলে একটি অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ এটি।

তারা বলছেন, বিগত চার-পাঁচ বছরে কফি মেশিনের প্রচলন এতটা বেড়েছে যে, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে এখন কফি মিলছে। এমনকি গ্রামেও কফি মেশিন রয়েছে বিভিন্ন খাবারের দোকানে। মূলত কফি মেশিনের মাধ্যমে কফি ব্যবসা দ্রুত বড় হচ্ছে।

jagonews24

এছাড়া ৫-১০ টাকায় কফির ছোট প্যাকেট পাওয়া যায়। এর ফলে রাস্তার চায়ের টংগুলোতেও অনেকে কফি খাচ্ছেন। অনেকে আবার চায়ের সঙ্গে কফি মিশিয়ে খেতেও পছন্দ করেন।

বাংলাদেশে কফির সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ও নেসলে বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক নকিব খান জাগো নিউজকে বলেন, দেশে এখন কফির সম্ভাবনা প্রচুর। কারণ নতুন প্রজন্ম কফিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি মধ্যবিত্ত তরুণ থেকে মধ্যবয়সী পর্যন্ত একটি শ্রেণি, যাদের সংখ্যাই এখন দেশে সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যেও এ অভ্যাস গড়ে উঠেছে। সেটাই এ বাজারের বড় সম্ভাবনা।

কফিতে সমস্যা উচ্চ শুল্ক

দেশে কফির জনপ্রিয়তা যে হারে বাড়ছে সেটি আরও বেশি হতো বলে মনে করেন বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। তারা এর উচ্চহারে শুল্ককে একটি বড় সমস্যা মনে করেন। যে কারণে অবৈধভাবে কফির আমদানি বাড়ছে বলেও মনে করেন তারা।

কারণ দেশে কফি এখনো বিলাসী পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত। সেজন্য কফি বাজারজাত করতে গুণতে হচ্ছে চড়া মূল্য। ক্রেতারাও সে কারণে কম দামে কফির স্বাদ নিতে পারছেন না।

এ বিষয়ে নেসলে বাংলাদেশের পরিচালক (ল’ অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) দেবব্রত রায় জাগো নিউজকে বলেন, কফি একটি স্বাস্থ্যকর পানীয়। এতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসহ প্রচুর ভালো উপাদান রয়েছে। কিন্তু সেটা বিলাসী পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। সর্বস্তরের মানুষ এ পানীয়ের উপকারিতাও পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, কফিতে উচ্চহারে শুল্ক রয়েছে। ২৫ শতাংশ সাধারণ শুল্ক, ৩ শতাংশ আরডি, ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা আছে। সব শুল্ক কর হিসেবে নিলে সেটা প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ এ দেশে কফির জন্য ভোক্তাকে দ্বিগুণ দাম দিতে হচ্ছে।

দেবব্রত রায় বলেন, এখন সরকারের নজর দেওয়া উচিত কীভাবে এ পরিস্থিতি থেকে বেরোনো যায়। কারণ এ উচ্চশুল্কের কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে। পণ্যটি নিয়ে সব স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় না। এ একই কারণে প্রচুর কফি শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে আমদানি হচ্ছে। নিয়ম মেনে ব্যবসা করা কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি নতুন বিনিয়োগও আসছে না।

দেশে হচ্ছে কফির চাষ
শুরুতে নব্বইয়ের দশকে পার্বত্য জেলাগুলোয় সীমিত পর্যায়ে সনাতন পদ্ধতিতে যে কফি চাষ শুরু হয়েছিল তা এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে। শুধু পাহাড়ে নয়, পার্বত্য জেলাগুলো ছাড়িয়ে কফি চাষ ছড়িয়ে পড়েছে নীলফামারী, টাঙ্গাইল ও মৌলভীবাজারসহ উত্তরের কয়েকটি জেলায়। অপ্রচলিত অর্থকরী এই ফসল চাষে উৎসাহ দিতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রায় সোয়া ২০০ কোটি টাকার আলাদা প্রকল্প নিচ্ছে সরকার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এ বিষয়ে বলছে, গত অর্থবছরে দেশে কফির উৎপাদন এলাকা ছিল প্রায় ১২২ হেক্টর, মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ৬০ টন। যদিও এ উৎপাদন মোট চাহিদার ৫ শতাংশেরও কম। সেজন্য বাকি চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করা কফি দিয়ে।

jagonews24

জানা গেছে, বাংলাদেশে দুই ধরনের কফির চাষ হচ্ছে এখন। একটি আফ্রিকার জাত কফিয়া ক্যানিফোরা, যা রোবাস্তা কফি নামে পরিচিত। অন্যটি কফিয়া অ্যারাবিকা; বিশ্বজোড়া তুমুল চাহিদার এই কফিটি পর্বত কফি নামেও পরিচিত বেশ।

এদিকে কফির বাণিজ্যিক উৎপাদন এগিয়ে নিতে স্থানীয়ভাবে কফির নতুন জাত উদ্ভাবনেও কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। নতুন জাতের নাম হবে বারি কফি-১। রোবাস্তা ও অ্যারাবিকা প্রজাতি থেকে ভারত, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে হাইব্রিড কফির নানা জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। তবে ততটা উচ্চতর গবেষণার দিকে এখনো যায়নি পাহাড়ি গবেষণা কেন্দ্র।

যদিও এখন যে সনাতন পদ্ধতিতে কফি উৎপাদন হচ্ছে, তাতে উৎপাদিত কফির বড় একটি অংশ অদক্ষতায় নষ্ট হয়। সেজন্য সহজ প্রযুক্তিও আনছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। পাশাপাশি কফি বাজারজাত করার কলাকৌশল শেখাতেও প্রশিক্ষণ জোরদার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে কফিকে এখনও ‘ইনফ্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে বর্ণনা করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা অনুষদের সাবেক ডিন ও কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির বর্তমান মহাসচিব মিজানুল হক কাজল বলেন, কফি চাষ খুবই সম্ভাবনাময়। এটি চাষে সরকারের অন্তরিকতা রয়েছে। এখন যদি কিছু প্রণোদনা দেওয়া যায়, ভবিষ্যতে সেটা লাভজনক হবে। আমরা আমদানি কমিয়ে আনতে পারবো। সেখান থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

 

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ