চেষ্টা-সাধনায় নবী হওয়া যায় না

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনার আগে (মানুষের মধ্য থেকে) পুরুষদেরকেই পাঠিয়েছিলাম, আমি তাদের কাছে ওহি পাঠিয়েছি, তোমরা যদি না জান তাহলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো। আমি তাদেরকে এমন দেহবিশিষ্ট করিনি যে তারা আহার্য গ্রহণ করত না, তারা চিরস্থায়ীও ছিল না। ’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৭-৮)

তাফসির : উল্লিখিত আয়াতে নবী নিয়ে কাফিরদের ভুল ধারণার জবাব দেওয়া হয়েছে। তাদের ধারণা ছিল যে নবী-রাসুলরা ছিলেন ফেরেশতা।

কিন্তু কোরআনের ভাষ্য মতে পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে কেবল পুরুষদের নবী-রাসুল হিসেবে পাঠানো হয়েছে। কারণ রিসালাত ও নবুওয়াতের মূল উদ্দেশ্য মানবজাতিকে হেদায়াত তথা আল্লাহর পথের দিশা দেওয়া। সমাজের সব শ্রেণিকে দাওয়াত দেওয়া, অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া, তাদের সঙ্গে বিতর্ক করা ও সব ধরনের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া নবুওয়াত ও রিসালতের অন্যতম দায়িত্ব। তাই মানুষের মধ্যে কেবল পুরুষদের নবী-রাসুলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার আগে জনপদের পুরুষদেরই কেবল আমি নবী হিসেবে পাঠিয়েছি, তাদরে কাছে আমি ওহি পাঠাতাম। ’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ১০৯)

নবী-রাসুলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তারা মানুষ। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে আল্লাহর দ্বিনের প্রচার করা যাবে। আর মানুষের পক্ষে তাদের মধ্য থেকে মনোনীত ব্যক্তিকে অনুসরণ করা সহজ। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি বলুন, আমি মানুষের মধ্যে নতুন কোনো নবী নই, আমি জানি না আমার ও তোমাদের ব্যাপারে (পরকালে) কী করা হবে, আমার প্রতি যা ওহি করা হয় আমি কেবল তাই অনুসরণ করি, আমি কেবল একজন সতর্ককারী। ’ (সুরা আহকাফ, আয়াত : ৯)

পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ২৫ জনের নাম পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। নাম জানা ও অজানা সব নবী ও রাসুলকে সত্য বলে বিশ্বাস করা সব মুসলিমের ঈমানের অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রথম মানুষ আদম (আ.)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাক্রম শুরু হয় এবং মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে তা শেষ হয়। পবিত্র কোরআনে নবী-রাসুলদের (আ.) মৌলিক চারটি কাজের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতগুলো পড়ে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। অথচ এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিমজ্জিত ছিল। ’ (সুরা : জুমুআ, আয়াত : ২)

অধিকাংশ আলেমদের মতে, রাসুল হলেন আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত সেই ব্যক্তি যাকে নতুন রিসালাত (আসামানি কিতাব) ও নতুন শরিয়ত (জীবনবিধান) দিয়ে কোনো জাতির কাছে পাঠানো হয়েছে। পক্ষান্তরে নবী হলেন আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সেই ব্যক্তি যিনি নিজ জাতির কাছে আগের রিসালাতের বিষয়কে স্মরণ করিয়ে দেবেন। তাই বোঝা যায়, সব রাসুল নবী হলেও সব নবী রাসুল নন। তাছাড়া উত্তম বংশের হওয়া, পুরুষ হওয়া, সত্যবাদী হওয়া ও উৎকৃষ্ট গুণাবলির অধিকারী হওয়া, আল্লাহর নির্দেশনা যথাযথভাবে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ হওয়া তাদের অন্যতম শর্ত। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী রাসুল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসুল আগমনের পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোনো অভিযোগ না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৬৫)

একজন নবী ও রাসুলের অন্যতম দায়িত্ব হলো আল্লাহর প্রেরিতে ওহির ভিত্তিতে মানুষকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের দাওয়াত দেওয়া, ভালো কাজের আদেশ দেওয়া, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা, শিরিক থেকে সতর্ক করা, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের নির্দেশনা দেওয়া, মানুষের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জানানো, সৃষ্টির উদ্দেশ্য-লক্ষ্য জানানো, পরকালের হিসাব ও মৃত্যু পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনের ব্যাপারে সতর্ক করা। কিন্তু তাদের গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য অর্জন বা অনুশীল করে নবী-রাসুল হওয়া যায় না। বরং বিষয়টি পুরোপুরি একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। (আশ শিফা, পৃষ্ঠা : ২৭)

নবী-রাসুলদের পুরুষ হওয়ার ক্ষেত্রে আবুল হাসান আল আশআরি (রহ.), কুরতুবি (রহ.), ইবনে হাজাম (রহ.)-সহ কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন। তবে তাদের এ মতের পক্ষে কোরআন ও হাদিস থেকে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ মেলে না। তাই আগের অনেক নারীকে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে মানবজাতির মধ্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী বলা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য বিশেষ মর্যাদা থাকলেও তারা নবী বা রাসুল ছিলেন না। তবে নবী-রাসুলদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে তাদের বড় ভূমিকা ছিল। যেমন ঈসা (আ.)-এর মাতা মারয়াম (আ.)-এর ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্মরণ করুন যখন ফেরেশতারা বলেছিল, হে মারয়াম, আল্লাহ তোমাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বের সব নারীদের মধ্যে তোমাকে মনোনীত করেছেন। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৪২)

মুসা (আ.)-এর মাতা মারয়াম (আ.)-এর ক্ষেত্রে ইরশাদ হয়েছে, ‘মারয়ামের পুত্র মাসিহ তো কেবল একজন রাসুল, তার আগে অনেক রাসুল গত হয়েছে এবং তার মাতা সত্যনিষ্ঠ ছিলেন, তারা উভয়ে খাবার আহার করতেন, দেখুন, আমি তাদের জন্য নিদর্শনগুলো কেমন বিশদভাবে বর্ণনা করি, আরো দেখুন, তারা কিভাবে সত্যবিমুখ হয়। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৭৫)

তবে বিশ্বজগতে তাদের মতো বিশেষ মর্যাদা আরো অনেকের জন্য ছিল। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদমকে, নুহকে ও ইবরাহিমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে বিশ্বজগতে মনোনীত করেছেন। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩৩) (আর রুসুল ওয়ার রিসালাত, পৃষ্ঠা : ৭৬, ফাতহুল বারি, ৪৪৭/৬)

গ্রন্থনায় : মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ