শেখ হাসিনার ভারত সফরে বাংলাদেশের পাঁচ চ্যালেঞ্জ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ সফরকালে ঢাকা-দিল্লির দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পাঁচটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ভবিষ্যতেও দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হবে এই চ্যালেঞ্জগুলো।
এ পাঁচটি চ্যালেঞ্জ হলো: তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন, গঙ্গা ব্যারাজ বাস্তবায়ন, স্থলসীমান্ত চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, সামরিক চুক্তি করা বা না করার সিদ্ধান্ত এবং সমুদ্রসীমানা-সংক্রান্ত সব ধরনের বিরোধের মীমাংসা।
এ বিষয়ে পানিসম্পদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে বাংলাদেশের এক নম্বর অগ্রাধিকারের বিষয় হলো পানি। বাংলাদেশ-ভারত দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা চুক্তির জন্য আলোচনা করে একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে। যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যাবে।

 

সরকারের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তার মতে, বড় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বরাবরই উষ্ণ রাখতে চায় বাংলাদেশ।

 

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। এ আট বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবার ভারত সফর করেছেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ঢাকা সফর করেছেন। এ সময়ের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটি বাংলাদেশ বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যদিকে, দিল্লি ঢাকার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ পানির বিষয়টি সমাধান করার বিষয়ে একমত হওয়ার পরও বিষয়টির সুরাহা করা যায়নি।

 

তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর

প্রায় চার দশক ধরে তিস্তা পানি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে বাংলাদেশ। ২০১১ সালে ভারত এ চুক্তি করতে সম্মত হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের চরম বিরোধিতার কারণে এ চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে একাধিকবার ভারত সরকারের সর্ব্বোচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বাস দেওয়ার পরও এ চুক্তি কবে হতে পারে, তা বলতে পারছে না ভারত। এ চুক্তির মূল বৈশিষ্ট্য হলো—বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন ৫৪ নদীর ক্ষেত্রে তিস্তা চুক্তির খসড়া ব্যবহার করা যাবে।

গঙ্গা ব্যারাজ

২০২৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তি শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ গঙ্গা ব্যারাজ বাস্তবায়ন করতে চায়। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তি করার সময় বাংলাদেশ এ প্রকল্পের বিষয়ে ভারতকে জানিয়েছিল। ২০১৪ সালে এই প্রকল্পের সারসংক্ষেপ হস্তান্তর করা হয়।

 

বাংলাদেশ ৪ বিলিয়ন ডলারের ব্যারাজ নির্মাণের বিষয়ে উদ্যোগী হয়। কারণ ভারত ১৯৭৫ সাল থেকে ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে ৪০ হাজার কিউসেক পানি অন্যদিকে সরিয়ে নিচ্ছে।

 

স্থলসীমান্ত চুক্তি

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত আছে ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার যা ১ হাজার ১৪৫টি স্ট্রিপ ম্যাপ দিয়ে নির্ধারিত হয়েছে। উভয়দেশ ১ হাজার ১৪৪টি স্ট্রিপ ম্যাপ স্বাক্ষর করলেও একটি স্ট্রিপ ম্যাপ স্বাক্ষর করতে রাজি হচ্ছে না ভারত। এটি হচ্ছে মুহুরির চরের স্ট্রিপ ম্যাপ।

 

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মুহুরির চরের স্ট্রিপ ম্যাপ স্বাক্ষরের সিদ্ধান্তটি দু’দেশের রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণী মহলের সর্ব্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসতে হবে। কারণ মুহুরির চরের এই একটি বিষয় ছাড়া ভারত সম্পূর্ণ চুক্তি মেনে নিয়েছে।’

 

সামরিক চুক্তি

অনেক দেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি থাকলেও বাংলাদেশ পৃথিবীর কোনও দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেনি। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোজ পারিকর গত ৩১ অক্টোবর দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। তখন ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঢাকা-দিল্লি সামরিক চুক্তির বিষয়টি সামনে আসে।

 

তখন মনোজ পারিকর বাংলাদেশের সিনিয়র রাজনৈতিক, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।

 

সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসা

ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ২০১০ সালে পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে মামলা করে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে এই মামলা রায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে, ভারত ২০১৬ ফেব্রুয়ারিতে সমুদ্রসীমানা এবং এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করে। রায়ে একটি ’গ্রে এরিয়া’ বিষয়ে বলা হয়েছে। যার উপরিভাগের সম্পদ ভারতের এবং সমুদ্র তলদেশের সম্পদ বাংলাদেশের। কিন্তু, উভয়দেশের গেজেটে বঙ্গোপসাগরের ঠিক কোন জায়গায় এই গ্রে এরিয়াটি অবস্থিত, তার কোনও উল্লেখ নেই।

 

প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফর

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় অমীমাংসিত থাকলেও পাঁচটি বিষয় কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘পানি বাংলাদেশের এক নম্বর অগ্রাধিকারের বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারত দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা চুক্তির জন্য আলোচনা করে একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে। যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে।’

 

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তবে এতে পশ্চিমবঙ্গের ভেটো বা বিরোধিতা দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অন্যান্য প্রদেশের রসায়ন বাংলাদেশের বিবেচ্য নয়। কেন্দ্রের শীর্ষ নেতৃত্ব ঢাকাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার পূর্ণ বাস্তবায়ন চায় বাংলাদেশ।’

 

গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পটিও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গঙ্গা ব্যারাজের মাধ্যমে ১৬৫ কিলোমিটার লম্বা একটি জলাধার তৈরি করা হবে যেখানে ২.৯ বিলিয়ন ঘন মিটার পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে প্রকল্পের সারসংক্ষেপ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সমীক্ষা চালানোর জন্য ভারত থেকে একটি প্রতিনিধি দলও সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছে।’

 

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরের সময়ে যে যৌথবিবৃতি প্রকাশ করা হয়, সেখানেও গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। দুই দেশের সহযোগিতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এটি হবে একটি যুগান্তকারী বিষয়।’ এর মাধ্যমেই পানির অববাহিকা ব্যবস্থাপনা সম্ভব হবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

 

উল্লেখ্য, স্থলসীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষর করা হলেও এটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এরপর সব বিষয় মিটে গেলেও একটি স্ট্রিপ ম্যাপ এখনও ভারত স্বাক্ষর করতে রাজি হয়নি। এই বিষয়ে ভূমি জরিপ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ভারত মুহুরির চরের বিষয়টি মেনে নিয়ে ২০১২ সালে ইনডেক্স ম্যাপ স্বাক্ষরের পর ২০১৪ সালে সীমান্ত পিলার স্থাপন করেছে। এখন তাদের এ বিষয় না মানার বিষয়টি দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি মীমাংসায় এখন শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’

 

সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি সংক্রান্ত মামলার রায় বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি সংক্রান্ত মামলার রায় বাস্তবায়নের পথে জটিলতা নিরসনের জন্য ইতোমধ্যেই ভারতের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে। এ বিষয়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লি সফরের সময়ে দু’টি বিষয় নিয়েই আলোচনা হতে পারে।’

সামনের দিনগুলো

বাংলাদেশের সামনের কৌশলগত পাঁচটি চ্যালেঞ্জের বিষয় নিয়ে ভারতের মনোভাব তিন ধরনের হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সরকারের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘ভারত তার ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ খাটিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে পারে। যেটি তাদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক হবে। দ্বিতীয়টি হতে পারে, চীন যেভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়তা করছে, সে ধরনের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে ভাতরও। কিন্তু এই সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। গত অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ঢাকা সফরের সময়ে ২৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। তৃতীয়টি হতে পারে, বাংলাদেশের সবচেয়ে অগ্রাধিকার প্রস্তাব মেনে নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।’

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময়ে অনেক কিছু পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশ চার দশক ধরে অপেক্ষা করছে। এখন দেখার বিষয়, এটি পূরণের পথে আমরা কতদূর অগ্রসর হতে পেরেছি।

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন