অর্থনৈতিক সঙ্কটের ৪ মাস

সিল্কসিটি ডেস্ক :
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস হানা দেওয়ার অর্থাৎ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ৪ মাস হলো আজ। এই চার মাসের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে দেশে ছিল সাধারণ ছুটি বা লকডাউন। যেকোনো দেশে এক দু’দিন সবকিছু বন্ধ থাকলেই বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়ে যায়, আর এত সময় ধরে সেটা চললে ক্ষতির পরিমাণটা যে আকাশচুম্বী হবে, তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।

করোনা শুধু মানুষের জীবনকেই সংকটে ফেলেনি, বরং জীবিকাকেও করে তুলেছে অনিশ্চিত। ফলে গোটা দেশের অর্থনীতিটাই এক বিরাট সংকটের মধ্যে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার প্রকোপ হয়তো আগামী কয়েক মাস বা দু’এক বছরে কমে আসবে। কিন্তু অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব থাকবে বহু বছর। কয়েক মাস আগেও আমাদের অর্থনীতি তড় তড় করে এগিয়ে যাচ্ছিল, করোনার হানায় সেটাই এখন থমকে গেছে। গত চার মাসে দেশের অর্থনীতিতে করোনা কতটা প্রভাব ফেললো সেটাই একটু দেখে নেওয়া যাক-

পোশাক শিল্প

আমাদের দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকা ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমিত হওয়ায় সেখানে চাহিদা কমেছে। তীব্র সংকটে ব্যবসা গুটাচ্ছে তাদের বড় ব্র্যান্ডগুলো। নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে ডিভিএফ স্টুডিও, জেসি পেনি, নিম্যান মারকোস গ্রুপ, আলডো গ্রুপ, জন ভারভ্যাটরস, জে হিলবার্ন, ট্রু রেলিজিয়ন, ফরেভার ২১, জারা, ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট। পিয়ার ১ জারা তাদের এক হাজার ২০০ স্টোর বন্ধ করে দিয়েছে, লা চাপেল চার হাজার ৩৯১ স্টোর তুলে নিয়েছে। বৈশ্বিক এমন সংকটে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। বিদায়ি অর্থবছরে খাতটি আয় হারিয়েছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিক কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। বিজিএমইএ এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলার আয় হলেও গত এক বছরে আয় ১৮.৪৫ শতাংশ কমে হয়েছে দুই হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।

ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের বেহাল দশা

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৮০ লক্ষ শিল্প উদ্যোগ আছে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির নিজস্ব হিসেবে সারাদেশে ৫৬ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানে ‘সাধারণ ছুটিতে’ দৈনিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। বর্তমানে সীমিত আকারে সবকিছু চালু হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা এখনও দূর অস্ত।

কৃষি ও সেবা খাত

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত ‘সাধারণ ছুটি’র কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মোটা দাগে- কৃষি, সেবা এবং শিল্প খাতে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে এখন সেবা খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া শিল্পখাত ৩৫ শতাংশ এবং কৃষির অবদান এখন ১৪ শতাংশের মতো।

কৃষি মৎস ও প্রাণিসম্পদ খাতে অর্থনৈতিক অবরুদ্ধ অবস্থার কারণে প্রতিদিন ২শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, শিল্প খাতে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ১শ ৩১ কোটি টাকা। আর সেবা খাতে, প্রতিদিনের ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা।

প্রবাসী আয়

দেশের এই খাতটি করোনার ফলে মহাসংকটে পড়েছে। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় করোনার ধাক্কা ও জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। রেমিটেন্সের বেশির ভাগ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে। আইএমএফের হিসাবে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। করোনা না থাকলে যা ১৮ শতাংশে পৌঁছাত। আইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবছর রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে কমে যাবে। এ সময় ৭ দশমিক ১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে এ খাতে।

সাম্প্রতিক তথ্য উপাত্ত বলছে, করোনার কারণে এ বছরের প্রথম ৩ মাসে দেশে ফিরে এসেছিলেন প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি। হিসাব বলছে, বাকি যে ৯৩ লাখের মত প্রবাসী বিভিন্ন দেশে রয়ে গিয়েছেন, কমেছে দেশে তাদের টাকা পাঠানোর পরিমাণও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম ২ মাসেও প্রবাসী আয় এসেছিল গেল বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। তবে এপ্রিলে যা কমেছে প্রায় ৩৫ ভাগ। এসেছে ৯৫ কোটি ডলারের মতো। গেল বছরের একই সময়ে যা ছিলো ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।

বেকার দেড় কোটি

করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ ও রফতানিমুখী দুই ধরনের অর্থনীতিতেই স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। এই স্থবিরতার প্রভাব পড়েছে চাকরির বাজারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারিয়েছেন। আর বাংলাদেশে এই সংখ্যাটা দেড় কোটি হতে পারে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এই দেড় কোটি মানুষের চাকরি হারানোর ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে অন্তত ৫ কোটি মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য)।

করোনায় বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির হিসেব দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের জানিয়েছে সাধারণ ছুটির প্রথম মাসেই দেশের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ১ লাখ ২ হাজার ৩শ কোটি টাকা। যা দৈনিক কমপক্ষে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিশ্বব্যাংক এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে করোনা মহামারি যদি আরও দীর্ঘ সময় ধরে চলে এবং সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে চলে যায় তাহলে আমাদের দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হবে, যা -৫.২ পর্যন্ত নেমে আসতে পারে।

স/রা