বিরোধী দলে থাকলে সবাই গণতন্ত্রী!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বিরোধী দলে থাকতে আমাদের রাজনীতিকদের মাথা খুলে যায় এবং তাঁরা হক কথা বলতে খুবই পছন্দ করেন। তাঁদের কথাবার্তা, আচরণ দেখে মনে হয় এমন গণতান্ত্রিক, পরমতসহিষ্ণু, উদার রাজনীতিক হয়তো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলের কথা না হয় বাদই দিলাম। গত ২৮ বছরে যাঁরাই যখন বিরোধী দলে ছিলেন, ভালো ভালো কথা বলেছেন, জনগণকে গণতন্ত্র সম্পর্কে নসিহত করেছেন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেসব তাঁরা বেমালুম ভুলে যান।

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও আলোচনা সভায় এমন কিছু কথা বলেছেন, যা গতানুগতিকতার বাইরে। তাঁর ভাষায়, একমাত্র ভারসাম্যের রাজনীতিই স্বেচ্ছাচারমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে পারে। নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে দেশে স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা পায়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। সেই সঙ্গে তিনি এ–ও যোগ করেছেন, একক দলীয় ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা বাড়িয়ে দেয়, রাজনৈতিক নেতা, সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে সরকার দেশের স্বার্থের বদলে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।

দলীয় স্বেচ্ছাচারিতা যে কত ভয়ংকর হতে পারে অধ্যাপক বি. চৌধুরীর মতো আর কেউ জানেন না। তিনি ছিলেন সামরিক শাসনামলে গঠিত বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। পরবর্তী কালে বিএনপি সরকারের শিক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদে উপনেতা হয়েছিলেন। এসব পদে থাকলে দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যত খটমট লাগুক না কেন তাঁকে দল ত্যাগ করতে হয়নি। কিন্তু যখনই দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী বিএনপিনিয়ন্ত্রিত অষ্টম সংসদের সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি হলেন, তখনই তিনি ‘ভারসাম্যহীন’ রাজনীতির শিকার হলেন। সে সময় রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে যাতে রাষ্ট্রপতির প্রচার বেশি না হয়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে লিখিত-অলিখিত নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। দলীয় রাষ্ট্রপতির খবর বেশি প্রচার পেলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়— এমন আজগুবি তত্ত্বও আবিষ্কার করেছিলেন সেদিনকার বিএনপির নেতৃত্ব।

অধ্যাপক চৌধুরী এখন সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী রাজনীতির বিরোধিতা করলেও একসময় সেটিই বিএনপির ভোটব্যাংক বলে প্রচার করতেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ নামে যে অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলেন, তাতেও সত্যমিথ্যের মিশেল ছিল। অভিজ্ঞ চিকিৎসক বি. চৌধুরীর রাজনীতিতে আসাটাও ছিল আকস্মিক। বিটিভিতে তাঁর ‘আপনার ডাক্তার’ অনুষ্ঠান দেখেই নাকি জিয়াউর রহমান তাঁকে দলের মহাসচিব করেছিলেন। যদিও তাঁর বাবা কফিলউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী।

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও বঙ্গভবনে অধ্যাপক বি. চৌধুরী গরিব রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানে বিটিভির ক্যামেরা হাজির হতো। এটা বিএনপির তরুণ নেতৃত্ব পছন্দ করতেন না। এরপর ৭ নভেম্বর ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ বার্ষিকীতে তাঁর দেওয়া বিবৃতিতে জিয়াউর রহমানকে শহীদ না বলায় বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা এতটাই ক্ষুব্ধ হলেন যে তাঁকে আক্ষরিক অর্থে গলাধাক্কা দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরে আসার পর তিনি যখন বিকল্পধারা নামে নতুন সংগঠন গড়তে চাইলেন, তখন বিএনপির গণতন্ত্রকামী নেতা-কর্মীরা মহাখালী রেল ক্রসিংয়ে ধাওয়া দিলেন। তখনকার সংসদে বিএনপির একজন গণতন্ত্রমনা মানুষ ছিলেন না—এ কথা বিশ্বাস করি না। কিন্তু তাঁদের কেউ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিবের প্রতি এই নিষ্ঠুর আচরণের নিন্দা বা প্রতিবাদ করেননি। রাজনীতিকেরা ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড় স্লোগান দেন; কিন্তু কাজ করেন ঠিক তার বিপরীত। অধ্যাপক বি. চৌধুরী আজ যেই ভারসাম্যের রাজনীতির কথা বলছেন, সেটা আমাদের দেশে কখনো আসেনি। একটি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বি. চৌধুরী এখন ভারসাম্যের রাজনীতির জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করছেন। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে (রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার আগ পর্যন্ত) এই তিনি ভুলেও ভারসাম্যের রাজনীতির কথা বলেননি।

অধ্যাপক চৌধুরীর মতো আমরাও একমত যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক সর্বনাশের মূলে। তাঁর কথিত রাজনৈতিক ভারসাম্য কিছুটা হলেও ১৯৯১ ও ১৯৯৬-এর সংসদে এসেছিল। কিন্তু আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। বিএনপি নেতারা ’৭৩-এর নির্বাচনে কারচুপির কথা বলেন, এরশাদ আমলের নির্বাচনী প্রহসন নিয়েও বেশ সোচ্চার। কিন্তু জিয়াউর রহমানের আমলে অনুষ্ঠিত ১৯৭৭-এর গণভোট, ১৯৭৮-এর রাষ্ট্রপতি কিংবা ১৯৭৯-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? সেসব নির্বাচনে কি কোনো ভারসাম্য ছিল? ’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ যত গণবিচ্ছিন্ন হয়ে থাক না কেন, ৩৯টি আসন পাওয়ার অবস্থায় ছিল না।

রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে হলে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান—সব ক্ষেত্রেই ভারসাম্য আনা জরুরি। তবে গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো গণতান্ত্রিক মানসিকতা। সামন্তীয় ধ্যানধারণা দিয়ে কোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যেমন গণতান্ত্রিক-কেন্দ্রিকতা দিয়েও সমাজতন্ত্রকে টেকসই করা যায়নি। ভারসাম্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে। ভারসাম্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেও। দল মানেই সমষ্টি, সেটি কোনো দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মানেন না। একটি বড় রাজনৈতিক দলের একজন সাবেক উপদেষ্টা আলাপ প্রসঙ্গে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমি উপদেষ্টা হয়েছি বটে, কিন্তু কাকে, কখন উপদেশ দেব বুঝতে পারছি না।’

নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়বে সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে কোনো কোনো পত্রিকা সেপ্টেম্বরকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করেছে। সত্যিই কি সেপ্টেম্বরে কিছু ঘটবে? নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, ডিসেম্বরের শেষ দিকে নির্বাচন হবে। সে ক্ষেত্রে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। আগামী নির্বাচনে কোন দলের ভরাডুবি হবে, কোন দল অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, সেসব নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীও করছেন নেতারা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি জোটের পরিসর বাড়ানোরও চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে নির্বাচনকালীন সরকার হবে, তাতে কে কে থাকবেন, কে কে বাদ পড়বেন, সেসব নিয়েও নানা জল্পনা চলছে। আওয়ামী লীগ মনে করে, তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলেই গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হবে। বিএনপি ভাবে, বর্তমান সরকারকে হটিয়ে তারা ক্ষমতায় আসতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু নির্বাচনের যে নিয়ামক শক্তি জনগণ, তাদের নিয়ে কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না।

আওয়ামী লীগের নেতারা এখন যা বলছেন, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির নেতারাও ঠিক একই কথা বলতেন। অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের বক্তৃতা-বিবৃতির ভাষাও বদলে যাবে। আমাদের রাজনীতিকেরা বিরোধী দলে থাকতে সাচ্চা গণতান্ত্রিক হয়ে যান। সরকারের গণতন্ত্র হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য রাখেন। কিন্তু তাঁরাই সরকারে গিয়ে সেসব ভুলে যান। গত ৪৭ বছরই এই মহড়া দেখে আসছি।

অধ্যাপক বি. চৌধুরী যে ভারসাম্যের রাজনীতির কথা বলেছেন, সেই ভারসাম্য হতে হবে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি—সব ক্ষেত্রে। সেই ভারসাম্য আনতে হবে সংসদে, নির্বাচনে, ক্ষমতার বণ্টনে। বি. চৌধুরী বলেছেন, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সর্বনাশের মূল। তিনি অসত্য বলেননি। কিন্তু তিনিও যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন ভারসাম্যের কথা চিন্তা করেননি। করলে হয়তো আমাদের আর গাড্ডায় পড়ে থাকতে হতো না। কমিউনিস্ট পার্টিসহ কয়েকটি দল আনুপাতিক ভোটের কথা বলে আসছে। তারা মনে করে, আনুপাতিক ভোট থাকলে ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকবে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল একদা সংসদে পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করার কথা বলত। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তাদের একাংশ আর পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের কথা বলে না। মৌলবাদ-আগুন সন্ত্রাসকেই গণতন্ত্রের একমাত্র বিপদ বলে মনে করে। গত চার বছর দেশে তাদের কথিত মৌলবাদ-আগুন সন্ত্রাস নেই। তারপরও কেন গণতন্ত্র মজবুত হলো না, কেন ভোটারদের মনের শঙ্কা গেল না, সেই প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই রাজনীতির ভারসাম্য খুঁজতে হবে।