৭ খুন মামলার রায়ের অপেক্ষায় নারায়ণগঞ্জ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার রায় ঘোষণা করা হবে সোমবার (১৬ জানুয়ারি)। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনে এ রায় ঘোষণা করবেন। মামলার সর্বশেষ ধাপ উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে গত বছরের ৩০ নভেম্বর রায়ের এ দিন ধার্য করেন আদালত।

 

সাত খুনের ঘটনায় দু’টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম একসঙ্গে শেষ হয়েছে। একটি মামলার বাদী নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল এবং অপরটির বাদী নিহত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি।

মামলা দু’টির চার্জশিটে ৩৫ জন অভিন্ন আসামি। তাদের মধ্যে ২৩ জন গ্রেফতার ও ১২ জন পলাতক আছেন।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন- নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১’র সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানা, র‌্যাবের সদস্য এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এএসআই বজলুর রহমান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার এমদাদুল হক, হাবিলদার নাসির উদ্দিন, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন কনস্টেবল বাবুল হাসান, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, বেলাল হোসেন, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, সিপাহী নুরুজ্জামান, সিপাহী আসাদুজ্জামান নূর এবং নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশার।

 

আর পলাতক আসামিরা হলেন- নূর হোসেনের সহযোগী ভারতে গ্রেফতার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান ও জামাল উদ্দিন এবং র‌্যাবের আট সদস্য কর্পোরাল লতিফুর রহমান, সৈনিক আবদুল আলী, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, এএসআই কামাল হোসেন ও কনস্টেবল হাবিবুর রহমান।

 

দু’টি মামলারই অভিন্ন সাক্ষী ১২৭ জন করে। তাদের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১০৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন আদালত।

 

২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল চার্জশিট দাখিল, ওই বছরের ১২ নভেম্বর ভারত থেকে নূর হোসেনকে দেশে আনা, আদালতে সাক্ষীদের চোখ রাঙানি, বাদীপক্ষকে হুমকি, অন্যতম আসামি র‌্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা তারেক সাঈদের অসুস্থতার নাটকে হাসপাতালে ভর্তি, কাঠগড়ার ভেতরে নূর হোসেনের মারামারিসহ অনেক নাটকীয়তাও হয়েছে মামলা চলাকালে।

 

মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, ‘গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে মাত্র ৮ মাসেই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। যুক্তিতর্ক ও আসামিদের জেরায় আমরা রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, অভিযুক্তরা সবাই সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা, গুমসহ পুরো কাজে জড়িত। সেহেতু আমরা আদালতকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ারও দাবি জানিয়েছি। আমরা আশা করি, আদালত মৃত্যুদণ্ডাদেশই দেবেন’।

 

বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘যেভাবে সাতজনকে হত্যা করা হয়েছে তা খুবই মর্মান্তিক ও নৃশংস। নিহত সাতজনের পরিবারগুলোর সদস্যরা এখনো কাঁদছেন। সাতখুনের মামলার সুষ্ঠু বিচার হবে এ প্রত্যাশা শুধু নারায়ণগঞ্জবাসীর নয়, সমগ্র বাংলাদেশের’।

 

‘আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা রয়েছে। সে আস্থা থেকেই আমাদের প্রত্যাশা, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হবে। সাক্ষ্য-প্রমাণেও আসামিদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে’।

 

একটি মামলার বাদী নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, ‘সাত খুনের পর থেকেই বিচার চাওয়ায় আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তারপরেও আমরা মামলার কার্যক্রম চালিয়েছি। আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। আমরা চাই, আদালত যেন তাদের মৃত্যুদণ্ড দেন’।

 

মামলার অন্য বাদী নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা ডা. বিজয় কুমার পাল বলেন, ‘দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছি’।

 

নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুপুর বেগম মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমি বিধবা হয়েছি। আমার সন্তান বাবাকে হারিয়েছে। আদালত যেন এর সুষ্ঠু বিচার করে আসামিদের ফাঁসি দেন’।

 

নিহত লিটনের ভাই রফিক মিয়া বলেন, ‘আমরা স্বজন হারিয়েছি। আমরাই এর দুঃখ বুঝি। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি’।

 

নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, ‘আমরা ভুক্তভোগী পরিবার। আমাদের প্রত্যাশা দেশবাসী জানে। তাই আদালতের কাছে প্রার্থনা, যেন এমন একটি রায় দেন, যাতে করে আর কোনো বাবাকে তার সন্তান না হারাতে হয়। আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানাচ্ছি’।

 

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে অপহরণের তিনদিন পর তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার ৪ সহকর্মী হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় একটি এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে একই থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন।

দীর্ঘ প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মণ্ডল সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

তবে একটি মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি তার মামলায় এজাহারভুক্ত ৫ আসামিকে বাদ দেওয়ায় এবং প্রধান আসামি নূর হোসেনের জবানবন্দি ছাড়া অভিযোগপত্র দেওয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। প্রথমে বিচারিক হাকিম আদালত ও পরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত তা খারিজ করে দেন। পরে সেলিনা ইসলাম বিউটি অধিকতর তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানালে আদালত শুনানি শেষে আদেশে বলেন, পুলিশ চাইলে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে পারে। তবে মামলাটিতে হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার ধারা যুক্ত করে বিচার করার জন্য জেলা ও দায়রা জজকে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।

গত বছরের ০৮ ফেব্রুয়ারি ৭ খুনের দু’টি মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৩ আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত।

র‌্যাবের ৮ সদস্যসহ পলাতক ১২ আসামির অনুপস্থিতিতেই বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। তবে পলাতক ১২ আসামির পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে ৫ জন আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সূত্র: বাংলা নিউজ