৫১ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি ড. জোহা দিবসের, কারণ অজানা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি:

‘আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে।’ ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে এভাবেই কণ্ঠ তুলেছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। এজন্য তাঁর শেষ পরিণতি হয়েছিল মৃত্যু। উর্দি পরিহিত পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম বেয়নেট চার্জে শাহাদাৎ বরণ করেন তিনি।

এরপর থেকে রাবি কর্তৃপক্ষ ১৮ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ ড. জোহা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। তবে দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে দিবসটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস করার দাবি জানালেও আজও তা হয়নি। তবে কেন স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না তার কারণ অজানা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, জোহা স্যার শিখিয়ে গেছেন কীভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়। তাঁর আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দিবসটিকে জাতীয়ভাবে ঘোষণা করার জন্য শিক্ষকেরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এর পরিবর্তে তারা নিজেদের মধ্যে পদ-পদবী নিয়ে রাজনীতি ও পরস্পর বিভাজনে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে শিক্ষকদের দাবি, তাঁরা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু কেন এতদিনেও দিবসটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়নি সেটা তাঁরা জানেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সূত্রে জানা গেছে, আসাদ ও সার্জেন্ট জহুরুলের খুনের প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে রাবি শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়েই সেখানে ছুটে যান শহীদ ড. জোহা। তাঁর সঙ্গে যান অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. আবদুল খালেক, অধ্যাপক ড. সুব্রত মজুমদার, অধ্যাপক ড. মোল্লাসহ অনেকে।

শহীদ জোহা হানাদারদের করজোর করে বলেছিলেন, প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে। এর কিছুক্ষণ পর অন্য শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েন। তাদের পেছনেই ছিলেন শহীদ জোহা। তখন চারদিক থেকে তাঁকে ঘিরে ধরে রক্তলোলুপ পাকিস্তানিরা। তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে থাকে ড. জোহাকে। তাঁর রক্তে ভেসে যায় মতিহারের সবুজ চত্বর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহানের আমলে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তখন জোহা দিবসকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণার বিষয়ে কথা হয়। তাঁরা বিষয়টি দেখবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশ্বাস আলোর মুখ দেখেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা বলছেন, শহীদ জোহা একজন মুক্তিকামী মানুষ ছিলেন। তাঁর আত্মত্যাগ গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম ফারুকী বলেন, ‘সমিতির পক্ষ থেকে দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির জন্য বর্তমান প্রশাসনকে এ বিষয়ে দ্রুত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’

রাবির জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রভাষ কুমার কর্মকার বলেন, জোহা দিবসে আমরা প্রতিবছরই নানা কর্মসূচি করে থাকি। আমাদের কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে জানানোর চেষ্টা করি যেন দিবসটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে রাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল কিনা সেটা আমার জানা নেই। তবে আমরা চাই দিবসটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।’

এদিকে ড. জোহার শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে আজ (মঙ্গলবার, ১৮.০২.২০) দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে প্রশাসন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল পৌনে ৭টায় ড. জোহার মাজার ও স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ। এরপর আলোচনা সভা, জোহা স্মারক বক্তৃতা, দোয়া অনুষ্ঠান, রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে।

উল্লেখ্য, শহীদ জোহা ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৫০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে বিএসসি (সম্মান) এবং ১৯৫৪ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। গণঅভ্যূত্থানের সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্বে ছিলেন।

স/স্ব