২০১৮ সালে ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আর মাত্র চার দিন পর বিদায় নেবে ২০১৮ সাল। বিদায়ের প্রাক্কালে পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যেতেই পারে। ক্রিকেটাঙ্গণের দিকে ফিরে তাকালে চলতি বছর ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল অস্ট্রেলিয়া দলের বল টেম্পারিং। গত মার্চে কেপটাউনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বল টেম্পারিং করেন তৎকালীন অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ, সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার ও তরুণ ওপেনার ক্যামেরন বেনক্রফট। ধরা পড়ার পর তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)।

বল টেম্পারিং পর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নতুন দুটি দেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়া। একদাশ ও দ্বাদশ দেশ হিসেবে যথাক্রমে আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ডকে টেস্ট মর্যাদা দেয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)।

চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে গত মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায় অস্ট্রেলিয়া। ডারবান টেস্টে ১১৮ রানে বড় ব্যবধানে হেরে সিরিজ শুরু করে পোর্ট এলিজাবেথে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচটিও ৬ উইকেটে হারতে হয় তাদের। সিরিজের লড়াইয়ে টিকে থাকা ম্যাচটি কলঙ্কিত করে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচের তৃতীয় দিন ডেভিড ওয়ার্নারের নির্দেশে এবং স্টিভেন স্মিথের মৌন সম্মতিতে বল টেম্পারিং করেন ক্যামেরন বেনক্রফট। ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট ফুটে উঠে ক্রিকেট দুনিয়ায়। পরবর্তীতে দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে বল বিকৃতির ঘটনা অকপটে স্বীকার করেন স্মিথ।

ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর কঠোর পদক্ষেপ নেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। স্মিথ-ওয়ার্নারকে এক বছরের জন্য, বেনক্রফটকে ৯ মাসের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিষিদ্ধ করা হয়। গত এপ্রিল থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধই আছেন স্মিথ-ওয়ার্নার-বেনক্রফট। তবে প্রায় নয় মাস পর বল বিকৃতির আসল ঘটনা তুলে ধরেন স্মিথ। বের হয় তাদের কুকীর্তির সকল ঘটনা।

এক সাক্ষাতকারে স্মিথ, ‘আমি পরিকল্পনাটা দেখেছি এবং বুঝেছিলামও যে কি হতে যাচ্ছে। কারন পরিকল্পনাটি হোটেলে আমার রুমেই হয়েছে। আমার ভুল ছিল, যে আমি তা দেখেও তাদের থামাইনি। তখন যদি আমি তাদের এসব করা থেকে বিরত রাখতাম, তাহলে হয়তো ঘটনাটি অন্যরকমও হতে পারত। চাইলেই আমি বল-টেম্পারিং পরিকল্পনা থামাতে পারতাম, কিন্তু করিনি। এটাই আমার ব্যর্থতা ছিল।’

স্মিথের এমন মন্তব্য শুনে মুখ বন্ধ করে রাখতে পারেননি তরুন খেলোয়াড় বেনক্রফট। বল বিকৃতির মূল হোতার নাম ফাঁস করে দেন তিনি। বেনক্রফট বলেন, ‘ওয়ার্নার আমাকে ম্যাচের ঐ পরিস্থিতে বল টেম্পারিং করতে বলেছিলেন। এ ব্যাপারে আমার কোন ধারনা ছিল না। আমি ভালোভাবে জানতামও না। আমি শুধু চেয়েছি দলে নিজেকে মানিয়ে নিতে, পরিস্থিতির মূল্য বুঝতে। সত্যি বলতে এটাই ছিল আমার মূল ভাবনা।’

বল বিকৃতির কারণে শুধুমাত্র স্মিথ-ওয়ার্নার বা বেনক্রফটই শাস্তি পাননি, বলির পাঠাঁ হতে হয়েছে কোচ ড্যারেন লেহম্যানকে। এই ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও কোচের পদ থেকে নিজেই অব্যাহতি নেন লেহম্যান। তার জায়গায় দলের দায়িত্ব পান সাবেক ওপেনার জাস্টিন ল্যাঙ্গার। আর অধিনায়কের দায়িত্ব পান টিম পেইন। ভারতের বিপক্ষে দেশের মাটিতে এখন টেস্ট সিরিজ নিয়ে ব্যস্ত পেইনের দল। দুটি টেস্ট শেষে সিরিজ ১-১ সমতায় আছে। চলছে তৃতীয় টেস্ট।

অস্ট্রেলিয়ার জন্য বছরটি খারাপ হলেও ভারত এবং তাদের অধিনায়ক বিরাট কোহলির জন্য ২০১৮ ছিল দুর্দান্ত। বিশেষভাবে কোহলির। এ বছর এখন পর্যন্ত কোহলিই একমাত্র ব্যাটসম্যান, যে-কিনা ১ হাজার রানের কোটা পূর্ণ করেছেন। এ বছর ১১টি সেঞ্চুরিও হাকিয়েছেন কোহলি। ৫টি টেস্টে, ৬টি ওয়ানডেতে।

টেস্ট ফরম্যাটে ইংল্যান্ডেরও জন্য বছরটি ভালো ছিল। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ সিরিজ ৪-০ ব্যবধানে হারে তারা। এরপর চলতি বছর নিউজিল্যান্ডের কাছে হারলেও দেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয় জো রুটের দল। এছাড়া দীর্ঘ ১৭ বছর পর শ্রীলঙ্কার মাটিতে ৩-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়ের কীর্তি গড়ে ইংল্যান্ড।

বছরের শেষ সময়ে এসে দুর্দান্তভাবে দলের চাহিদা মিটিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। আবুধাবিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টেস্টে ১৩৯ রানের নান্দনিক ইনিংস খেলে নিউজিল্যান্ডকে নাটকীয়ভাবে ১২৩ রানের জয়ের স্বাদ দেন তিনি। যার মাধ্যমে ৪৯ বছর পর বিদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ নেয় কিউইরা।

চলতি বছর তারকাদের মধ্যে অবসর নিয়েছেন ইংল্যান্ডের অ্যালিষ্টার কুক, দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্স ও শ্রীলঙ্কার রঙ্গনা হেরাথ। ১৬১ টেস্টে ১২,৪৭২ রান করেছেন কুক। ওভালে নিজের শেষ টেস্টের শেষ ইনিংসে ভারতের বিপক্ষে ১৪৭ রান করেন কুক।তিন ফরম্যাটেই বেশ সফল ছিলেন ডি ভিলিয়ার্স। দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে ১১৪ টেস্টে ৮৭৬৫ রান, ২২৮ ওয়ানডেতে ৯৫৭৭ রান ও ৭৮টি টি-টোয়েন্টিতে ১৬৭২ রানের মালিক তিনি।

১৯৯৯ সালে টেস্ট দিয়ে অভিষেক ঘটে হেরাথের। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। চলতি বছরের নভেম্বরে টেস্ট দিয়েই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন এই স্পিন মহাতারকা। গল দিয়ে শুরু করে সেখানেই ক্যারিয়ার শেষ করেন ৯৩ টেস্টে ৪৩৩ উইকেট নেন হেরাথ।

টি-টোয়েন্টিতে না পারলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বছরের শেষভাগে টেস্ট-ওয়ানডে সিরিজ জিতে বাংলাদেশ। তারপরও তাদের বেশ লড়াই করতে হয়েছে। চলতি বছর ৮ টেস্টে ৩টি জয়, ৪টি হার ও ১টি ড্র করে টাইগাররা। ৪টি টেস্ট সিরিজের মধ্যে ১টিতে জয়, ২টিতে হার ও ১টি ড্র করে। তবে ওয়ানডেতে বেশ চাঙ্গা ছিল বাংলাদেশ। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে ২০ ম্যাচে ১৩টি জয় ও ৭টি হার নিঃসন্দেহে উন্নতির লক্ষণ। তবে টি-টোয়েন্টি তে বেশ এলোমেলো ছিল বাংলাদেশ। ১৬ ম্যাচে মাত্র ৫টিতে জিতেছে। বাকী ১১ ম্যাচে পেতে হয়েছে হারের লজ্জা।

এ বছরই টেস্ট আঙ্গিনায় পথ চলা শুরু হয় আফগানিস্তান-আয়ারল্যান্ডের। গত মে মাসে ডাবলিনে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হয় আইরিশদের। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরও ৫ উইকেটে ম্যাচ হারে আয়ারল্যান্ড। এ ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের পক্ষে সেঞ্চুরি করেন কেভিন ও’ব্রায়ান। পরের মাসে টেস্ট আঙ্গিনায় অভিষেক ঘটে আফগানিস্তানের। বেঙ্গালুরুতে ভারতের কাছে ইনিংস ও ২৬২ রানে ম্যাচ হারে আফগানরা। আয়ারল্যান্ডের মত লড়াইয়ের ছিটেফটাও দেখাতে পারেনি আফগানিস্তান।

চলতি বছর টেস্ট ফরম্যাট নিয়ে একটি গবেষণায় করেছে দ্য টাইমস পত্রিকা। তারা জানায়, ১৯৫৯ সালের পর এ বছর প্রতি উইকেটে সবচেয়ে কম রান উঠেছে।

এ বছর ম্যাচ ফিক্সিং সর্ম্পকিত ঘটনাও ছিল। ম্যাচ ফিক্সিং দুর্নীতিরও বিষয়ে আইসিসিকে সহযোগিতা না করায় শাস্তি পেতে হয় শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক ও প্রধান নির্বাচক সনাথ জয়সুরিয়াকে। নিজ দেশের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগের বছরে আইসিসি র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে থেকে বছর শেষ করতে পারছে ইংল্যান্ড। এ বছর ৫টি ওয়ানডে সিরিজ জিতে ইংলিশরা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সফরকারী হিসেবে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-শ্রীলঙ্কার মাটিতে সিরিজ জয়। তাই বিশ্বকাপের এমন অর্জন ইংলিশদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে অনুপ্রাণিত করবে।

অস্ট্রেলিয়া পুরুষ দলের জন্য বছরটি কলঙ্কিত হলেও, নারী দলের সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মত। আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে অজি মেয়েরা। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে তারা হারিয়েছিল ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে।