১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুরের জর্জ বাহিনী

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যেমন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে, তেমনি অবদান রাখে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর এভাবে ব্যক্তির নেতৃত্বেও গড়ে ওঠে শক্তিশালী গণবাহিনী। এ রকম বাহিনীর মধ্যে হেমায়েত বাহিনী, মুজিব বাহিনী, কাদের বাহিনী, মতিয়া বাহিনী ও দিনাজপুরের জর্জ বাহিনীর নাম উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জর্জভাই তাই অতিপরিচিত নাম। কিন্তু এযাবৎকালে দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত ইতিহাস রচিত হয়েছে, জর্জ দাশ সেখানে অনেকটাই অনুজ্জ্বল। কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে আলোচিত হলেও তাঁর কর্মকাণ্ডের যোগ্য উপস্থাপনা নেই বললেই চলে। অথচ দিনাজপুরের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালেও আওয়ামী লীগ কর্তৃক মনোনীত হয়ে তিনি প্রথমে ৫০০ যুবককে গেরিলা ট্রেনিং দেন। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মেহরাব আলী তাঁর ‘দিনাজপুরের ইতিহাসসমগ্র’ বইটির পঞ্চম খণ্ডে বলেন, ‘শহরের বুকে দৈনন্দিন মিটিং-মিছিল ছাড়াও যুদ্ধোন্মুখ যুবকদের সমন্বয়ে শহরে কতিপয় গুপ্ত ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়। আওয়ামী লীগ কর্তৃপক্ষ গোপনে ৫০০ তরুণকে গেরিলা ট্রেনিং দেওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় জর্জ ভাইয়ের পর। তিনি তখন সদ্য অবসর প্রাপ্ত একজন ইপিয়ার।’ (পৃ. ২৫০)

 

জর্জ দাশ ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক। তিনি ১১ বছর ইপিআরে চাকরি করেন। তিনি সামরিক শিক্ষকতা, ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং আইএনটি নায়েক প্রমোশন কোর্স সমাপ্ত করেন। জর্জ দাশের রেজি. নং ছিল ১০৬৫৮ এবং তিনি ইপিআরের ল্যান্স নায়েক ছিলেন। মিথ্যে পঙ্গুত্ব দেখিয়ে তাঁকে ইপিআর থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রতিনিয়তই যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছিলেন কুঠিবাড়ী তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গে। যার ফলে ২৭ মার্চ কুঠিবাড়ী অপারেশন সফল হয়। তিনি দিনাজপুর স্টেডিয়ামে ও বালুয়াডাঙ্গার অস্থায়ী ক্যাম্পের স্থানীয় যুবকদের গেরিলা ট্রেনিং দেন।

 

২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি বড় শহরগুলোতে নির্বিচারে গণহত্যা, জ্বালাও-পোড়াওসহ যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল, তার খবর দিনাজপুরে একটু দেরিতে পৌঁছালেও মুক্তিযুদ্ধের আগুন ঠিকই জ্বলে উঠেছিল দিনাজপুরবাসীর মধ্যে। সেই আগুনে প্রথম ভস্মীভূত হয় দিনাজপুরের পাক-বাহিনীর কুঠিবাড়ী ব্যারাক। ‘ওয়কিবহাল মহলের মতে, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল দিনাজপুরে এবং দিনাজপুরে সেই যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল পাকিস্তানিদের দুর্জয় ঘাঁটি কুঠিবাড়ী ব্যারাক থেকে। কজন নামহীন, খ্যাতিহীন, পদমর্যাদাহীন বাঙালি ইপিআর জওয়ান শুরু করেছিলেন সেই সংগ্রাম।’ ( মেহরাব আলী, প্রাগুক্ত,পৃ : ২৪৭)

 

২৭ মার্চ কুঠিবাড়ী অস্ত্রাগার দখল করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনাজপুরবাসীর আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধ। ওই সময় কুঠিবাড়ীতে ছিলেন বাঙালি জওয়ান হাবিলদার ভুলু, সেক্টর কোয়ার্টার মাস্টার আবু সাঈদ, প্লাটুন হাবিলদার নাজেম ও সুবেদার আরব আলী। বিকেল ৩টা থেকে ৪টার দিকে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগকারী সিগন্যাল সেটের জিপটিকে ঝড়ের বেগে ব্যারাকে প্রবেশ করতে দেখে বাঙালি ইপিআররা অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা হাবিলদার পাঞ্জাবি খালেককে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় ব্যারাকে থাকা সব পাকসেনা নিহত হয়। কুঠিবাড়ী তখন বাঙালি জওয়ানদের দখলে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরো দুই দিন এর জের হিসেবে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে।

 

এ সময় সেনা অফিসাররা সার্কিট হাউস, স্টেশন ক্লাব, পুলিশ লাইনসহ অন্যান্য নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্যাপ্টিস্ট মিশনকে অ্যাডভান্স হিসেবে নিয়ে পাকবাহিনী কুঠিবাড়ীর দিকে গুলিবর্ষণ করতে থাকলে বাঙালি ইপিআরের সদস্যরা কুঠিবাড়ীর পশ্চিম দিকের দেয়াল ভেঙে বের হয়ে এসে নদীর চরের ঢাল থেকে পাল্টা আক্রমণ করতে থাকে। শত্রুপক্ষ পশ্চাৎপসারণ করলে সেখানে উত্তেজিত জনগণ ও নেতারা পৌঁছে যান। শুরু হয় কুঠিবাড়ীর আস্ত্রাগার লুট। এঁদের মধ্যে যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁরা হলেন—অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম আবদুর রহীম এবং অনুগামীরূপে তরুণ নেতাদের মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকী, বেশারউদ্দিন মাস্টার, মহিউদ্দিন মাস্টার, নাদির চৌধুরী, জর্জ ভাই, শফিকুল হক ছুটু প্রমুখ মুক্তিসংগ্রামী চূড়ান্ত বিপদের মধ্যেও মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অকুস্থলে উপস্থিত থেকে বিপ্লবীদের তদারকির দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। এ ছাড়া শহরের ও বাইরের চতুর্দিকের গ্রামগুলো থেকে ছুটে আসা মুক্তিসংগ্রামী যুবকরাও ছিলেন অনেক। তন্মধ্যে বিশিষ্ট যাঁরা তাঁদের মধ্যে রবার্ট-লুইস ভ্রাতৃরা, আবুল কাশেম অরু, মজু খাঁ, আমজাদ হোসেন, রফিকুল ইসলাম, হালিম গজনবী, মকছেদ আলী মঙ্গোলিয়া, আবুল হায়াত, আমানুল্লাহ, গেরা, সইফুদ্দিন আকতার এবং দূর গ্রামের মনসুর আলী মুন্সি (বেজোড়া) নজরুল ইসলাম (তেঘরা) ও আরো অনেক অনেক সংগ্রামী তরুণ, অর্থাৎ উদ্যোগী সংগ্রামীরা এমন কেউ বাদ ছিল না যারা ওই সময় কুঠিবাড়ীর দিকে ছুটে আসে নাই।’ (মেহরাব আলী, প্রাগুক্ত, পৃ : ২৭৩)

 

২৬ মার্চ রাতে, অর্থাৎ পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ লেগে যাওয়ার প্রাক্কালে দক্ষিণ কোতোয়ালির গদাগাড়ী হাটে অনুষ্ঠিত হয় অগ্রণী সংগ্রাম পরিষদ। উক্ত পরিষদেও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জর্জ ভাই। এ প্রসঙ্গে মেহরাব আলী বলেন, “২৬ মার্চ রাত্রে দক্ষিণ কোতোয়ালির গদাগাড়ী হাটে সর্বসাধারণের অনুষ্ঠিত বৈঠকে এমনই এক অগ্রণী সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধেও বিশিষ্ট সংগঠক এবং এমপি আবদুর রহীমের রচনায়। সেটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কেবিএম কলেজ ক্যাম্প’। উক্ত ক্যাম্প গঠনে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রহীম এমপি এবং অন্যদের মধ্যে আনোয়ার সরকার, ইয়াকুব আলী মাস্টার, গোলাম রহমান মাস্টার, নাদিও চৌধুরী, আশরাফ সিদ্দিকী, কামাল ভাই, জর্জ ভাই, হবি চেয়ারম্যান, মহিউদ্দিন মাস্টার, বেশার উদ্দিন মাস্টার, ইউসুফ আলী মাস্টার, মো. এহসীন, সেকেন্দার আলী, সফর আলী প্রমুখসহ অনেক বুদ্ধিজীবী। এভাবেই মুক্তিযুদের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল দিনাজপুরের, ছাত্রনেতা এবং যুবনেতাও।” এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রাক্তন এমপি বলেন, ‘২৬ মার্চ দিবাগত রাত্রিতে গোদাগাড়ী হাটে সমবেত হয়ে মিটিং করি এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, শহরের দক্ষিণসংলগ্ন কেবিএম কলেজে সংগ্রাম ক্যাম্প করা হবে এবং সেখান থেকে পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করা হবে। কেবিএম কলেজ সংগ্রাম পরিষদ ক্যাম্পে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন হবিবুর রহমান চেয়ারম্যান, মহিউদ্দিন মাস্টার, বেশার উদ্দিন মাস্টার, ইউসুফ আলী মাস্টার, মোহাম্মদ আলী মাস্টার, মো. মোহসীন, নাদির চৌধুরী, মি. জর্জসহ ছাত্র-জনতা, পুলিশ ও ইপিয়ার জোয়ান।” (প্রাগুক্ত, পৃ : ২৫৭)

 

২৮ মার্চ বাঙালি ইপিআররা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এর নেপথ্যে জর্জের আন্তরিক তৎপরতার তথ্য পাওয়া যায়। এদিকে দিনাজপুর মিশন হাসপাতালের পশ্চিম-উত্তরে পুলের কাছে হবিবুর চেয়ারম্যানের ছোট ভাইসহ পাঁচজনের লাশ ফেলে রাখে আর্মিরা। লাশগুলো ফুলতরা শ্মশানঘাটের কাছে নদীর তীরে পড়েছিল। সাধারণ মানুষ লাশগুলো দেখতে পেলে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা কুঠিবাড়ীর দিকে ছুটতে থাকে শহর ও গ্রামবাসীর হাতে দা, কুড়াল, বটি-বল্লম লাঠিসোটা। মুহূর্তেই বিহারি ও বাঙালিদের সঙ্গে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টার জন্য কুঠিবাড়ী ব্যারাক অবরুদ্ধ হয়। দিনাজপুরের মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষ এক একজন সাহসী সৈনিক হয়ে ওঠে। এদিকে পূর্বপরিকল্পনা মতো বর্ডার পোস্টে বাঙালি ইপিআরদের খবর পাঠানো হয়, যাতে তারা কুঠিবাড়ী আক্রমণের সময় জওয়ানদের সাহায্য করতে পারে। এ প্রসঙ্গে তাঁর সহযোদ্ধা আবু তোরাব আমানুল্লা বলেন, ‘এভাবে ২৮ তারিখ কুঠিবাড়ী আক্রমণ ও বাঙালি ইপিআরদের বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলতে থাকলে ২৭ তারিখ এই বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার জন্য ভূতপূর্ব ইপিআর লেন্সনায়েক জর্জ ও তার ভাই লুইস বিরল থেকে দিনাজপুর শহরে এসে কুঠিবাড়ী বাঙালি জোয়ানদের সঙ্গে হাত মেলান।… ২৭ তারিখ জর্জ বিরল থেকে দিনাজপুর এসে বাঙালি জোয়ানদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় এবং স্থানীয় যুবকদের তৎপরতায় কুঠিবাড়ী আক্রমণের গতি বেগবান হয়।’ (শাহজাহান শাহ, ড. মাসুদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ : দিনাজপুর, পৃ : ৩৮)

 

২৮ মার্চ সকালের ঘোষণায় তিন ঘণ্টার জন্য দিনাজপুরে কারফিউ শিথিল করা হয়। ‘বেলা ৩টা বাজার আগে প্রথমেই ৬ পাউন্ডের গুলির শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে ঝড় সৃষ্টি হলো যেন। আসলে অপারেশন শুরু হয়েছে বেলা ২টা থেকেই। কুঠিবাড়ী সেক্টর হেডকোয়ার্টারে যত অবাঙালি ইপিয়ার জওয়ান এবং অফিসার ছিল তাদের বেয়নেট দিয়ে শেষ করতে হয়েছে। কারণ গুলির শব্দ হলেই কয়েকশ গজ দূরে অবস্থান গ্রহণকারী মিলিটারির কাছে খবর পৌঁছে যেত ইপিআরদের টার্গেট ছিল সার্কিট হাউসের পাশের ময়দান এবং বড় ময়দানের মাঝখানে অবস্থিত অফিসার্সস ক্লাব। এ গলিতেই মিলিটারিরা অবস্থান নিয়েছিল।… উপর্যুক্ত স্থান ছাড়াও রাজবাড়ি কাটাপাড়া ও সুইহারী ডিগ্রি কলেজের ছাদের উপরেও যে মিলিটারিরা পজিশন নিয়েছিল সেটা ইপিআররা জানতে পারেনি। তিন দিকের গুলির আক্রমণে তারা অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেল। তখন তারা একটা নতুন কৌশল গ্রহণ করল। কুঠিবাড়ীর পশ্চিম পাশের প্রাচীর ভেঙে তারা নদীর বালুর ওপর অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করল। এটা মিলিটারিরা টের পেল না। এ সময় কাঞ্চন ঘাট, বাইশাপাড়া কাঞ্চন রেলওয়ে ব্রিজের পশ্চিম পাশে উঁচু লাইনের দুই পাশে নিচু জায়গায় হাজার হাজার উল্লাসিত মানুষের ঢল।’ (মেহরাব আলী, প্রাগুক্ত, পৃ : ২৭৩)

শত্রুপক্ষ পশ্চাৎপসারণ করলে সেখানে উত্তেজিত জনগণ ও নেতারা পৌঁছে যান। শুরু হয় কুঠিবাড়ীর আস্ত্রাগার লুট। এঁদের মধ্যে যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁরা হলেন—অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম. আবদুর রহীম এবং অনুগামীরূপে তরুণ নেতাদের মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকী, বেশারউদ্দিন মাস্টার, মহিউদ্দিন মাস্টার, নাদির চৌধুরী, জর্জ ভাই, শফিকুল হক ছুটু প্রমুখ মুক্তিসংগ্রামীর চূড়ান্ত বিপদের মধ্যেও মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অকুস্থলে উপস্থিত থেকে বিপ্লবীদের তদারকির দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। এ ছাড়া শহরের ও বাইরের চতুর্দিকের গ্রাম থেকে ছুটে আসা মুক্তিসংগ্রামী যুবকরাও ছিলেন অনেক। তন্মধ্যে বিশিষ্ট যাঁরা তাঁদের মধ্যে রবার্ট-লুইস ভ্রাতৃগণ, আবুল কাশেম অরু, মজু খাঁ, আমজাদ হোসেন, রফিকুল ইসলাম, হালিম গজনবী, মকছেদ আলী মঙ্গোলিয়া, আবুল হায়াত, আমানুল্লাহ, গেরা, সইফুদ্দিন আকতার এবং দূর গ্রামের মনসুর আলী মুন্সি (বেজোড়া) নজরুল ইসলাম (তেঘরা) ও আরো অনেক অনেক সংগ্রামী তরুণ অর্থাৎ উদ্যোগী সংগ্রামী এমন কেউ বাদ ছিল না যারা ওই সময় কুঠিবাড়ীর দিকে ছুটে আসে নাই।’ (প্রাগুক্ত, পৃ : ২৭৩)

 

কুঠিবাড়ী যুদ্ধ সম্পর্কে জর্জ দাশ বলেন, ‘মার্চেও ২৭ তারিখে এক ভয়াবহ বীভৎস পরিবেশের মধ্যে আমরা সামান্য ৩০৩ রাইফেল, কয়েকটা স্টেনগান আর কিছু ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড ও এল এমজি দিয়ে এক আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে সামনাসামনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। অবশেষে ওদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হই। এই যুদ্ধে অসংখ্য খান সেনা হতাহত হয়।’ (মুক্তিযুদ্ধে আমরা : খ্রিস্টানদের অবদান, আমাদের ইতিহাস প্রকল্প, প্রতিবেশী প্রকাশনী, পৃ. ৩১) দিনাজপুর মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিকদারগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ে একটি ক্যাম্প গঠন করা হয়। ‘ঐ ক্যাম্পে কিছু জওয়ানসহ দশমাইল ও ভুষির বন্দর এলাকার যুবকদের নিয়ে দশমাইল ও ভুষির বন্দর এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে পাকসেনাদের সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর প্রবেশের গতি রোধ করার জন্য ডিফেন্স তৈরি করা হয়। ঐ ডিফেন্সে ইপিআরের সঙ্গে কোথাও বা পৃথকভাবে কেবিএম কলেজ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধরাও ছিল। এই ডিফেন্স ক্যাম্পের পরিচালক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীন।… এ সময় দিনাজপুর শহরের স্টেডিয়ামে আনসার অ্যাডজুটেন্টের সহায়তায় মি. জর্জের কাছে রাইফেল ট্রেনিং নিতে শুরু করে কয়েকশ ছেলে।’ (শাহজাহান শাহ, ড. মাসুদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ : দিনাজপুর, পৃ. ৪২)

 

দিনাজপুর শত্রুমুক্ত ছিল ১২/১৩ দিন, অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা ইপিআরদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করছিল, যাতে পাকবাহিনীদের প্রতিরোধ করা যায় কিন্তু সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনীর লোকেরা সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক নিয়ে যেভাবে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হয় তাতে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। শত্রুরা মর্টার সেল ও ভারী কামানের গোলা ছুড়তে ছুড়তে শহরের প্রবেশ করে। বলা বাহুল্য দিনাজপুর ফল করে।১২ এপ্রিল দিনাজপুরের অদূরে শুরু হয় দশমাইলের যুদ্ধ। এ প্রসঙ্গে জর্জ দাশ বলেন, ‘এপ্রিলের ১২ তরিখে শুরু হয় দিনাজপুরের অদূরে দশমাইলের যুদ্ধ। ট্যাঙ্ক, মর্টার ও কামানের গুলিবর্ষণের মুখে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। প্রথমে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। পরে বিরল ও রাধিকাপুর সীমান্তে এবং রামচন্দ্রপুর বিওপি ও কিশোরীগঞ্জ বিওপি এলাকায় শত্রুবাহিনীর প্রতিরোধ করি। এ সময় বিরল রেলস্টেশন মাস্টার জনাব জহুরুল আলম সাহেব শত্রুদেও সংবাদ ও অবস্থান জানিয়ে আমাদের সহায়তা করে। কিন্তু শত্রুপক্ষের গুপ্তচরেরা জনাব আলমকে ধরিয়ে দিলে শত্রুরা তাকে চরম নির্যাতনে হত্যা করে।’

 

১৩ এপ্রিল দিনাজপুর ফল করলে জর্জ দাশ বাঙালি ইপিআরদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে বিরল থানার কাঞ্চন নদীপাড়ে অস্থায়ী ডিফেন্স থেকে পিছিয়ে কিশোরীগঞ্জ অস্থায়ী ক্যাম্প হয়ে ডিফেন্স নিয়েই তিনি ভারতের রাধিকাপুরে আশ্রয় নেন। এ সময় দিনাজপুরের অসহযোগ আন্দোলনের বিশিষ্ট সংগঠক আনোয়ারুল কাদের জুয়েল এ সময় তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। জর্জ দাশ সেখান থেকে পুনরায় বাংলাদেশের ঠনঠনিয়া গ্রাম দিয়ে পাকবাহিনী কর্তৃক দখলকৃত কিশোরীগঞ্জ ক্যাম্প আক্রমণ করেন।

 

১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করার পর সারা বাংলাদেশে মুজিব নগর সরকারে নেতৃত্বে সংগঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি (পদাধিকার বলে সশস্ত্র বাহিনীর ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক)। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বধিনায়ক) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। অন্য তিনজন মন্ত্রী ছিলেন অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এসব সেক্টর আবার বেশ কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। এভাবে দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমা (বর্তমান জেলা) ও রংপুর ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন। আর দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া ছিল ৭ নম্বর সেক্টরেরর অধীন। অন্যান্য অঞ্চলের মতো দিনাজপুরেও সরকারের দুটি নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী ছিল। বাঙালি ইপিআরদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল নিয়মিত বাহিনী আর ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ও সকল পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন অনিয়মিত বাহিনীর সদস্য, যাদের সরকারি নাম ছিল এফএম বা ফ্রিডম ফাইটার।

 

মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণের পরপরই সকল স্তরে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এদিকে দিনাজপুর ৬ নম্বর সেক্টরের শিববাটি ক্যাম্পের দায়িত্ব অর্পিত হয় জর্জ দাশের ওপর। মি. জর্জ দাশ শিববাড়ী ক্যাম্পের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শ্রেণির ক্যাম্প ইনচার্জের মর্যাদা লাভ করেন। জর্জ দাশ ইয়ুথ ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, তিনি সরাসরি তার বাহিনী নিয়ে গেরিলা অপারেশন চালাতেন। তাঁর সম্পর্কে মাসুদুল হক ‘মুক্তিযুদ্ধ : দিনাজপুর’ বইয়ে বলেন, “মি. জর্জের গেরিলা ট্রেনিং প্রদান কৌশল, সাংগঠনিক তৎপরতা, মোটিভেশন, ব্যক্তিক আচরণের প্রভাব এবং সরাসরি গেরিলাযুদ্ধে বীরক্রিমে অংশগ্রহণের তৎপরতার জন্য তৎকালীন সময়ে শিববাড়ি ট্রেনিং ক্যাম্পে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি ও তাঁর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের সমন্বয় গঠিত দলটি শেষ পর্যন্ত ‘জর্জ বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।” যুদ্ধকালীন তিনি প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং দেন। তাঁর বাহিনীতে প্রায় ৪হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে জানান তাঁর সেজ ভাই মুক্তিযোদ্ধা রবার্ট আর এন দাশ ও মেজো ভাই মুক্তিযোদ্ধা জেমস এন এন দাশ, অর্থাৎ লুইস দাশ।

 

টানা নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ দাশ কুঠিবাড়ী যুদ্ধসহ, দশমাইলের যুদ্ধ, বিরল, খানপুর, গোয়ারবাড়ি, ধর্মপুর, জামালপুর, হাকিমপুর, রামসাগর ও সরস্বতী এলাকাতে অসংখ্যবার যুদ্ধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে এম এ কাফি সরকার তাঁর ‘দিনাজপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইতে বলেন, ‘শরণার্থীদের রেশন খেয়ে বিনা বেতনে জর্জ গ্রুপের ছেলেরা লড়েছেন। জীবন দিয়েছেন। শিববাড়ী ক্যাম্প থেকে মাত্র দেড় মাসের প্রশিক্ষণে হামজাপুর ফন্টে পাঠানো হয় প্রায় ৬০০ জন মুক্তিসেনানি। ৪১ জন গিয়েছিল মাদ্রাজ রেজিমেন্টের সঙ্গে সুইসাইড স্কোয়াডে। অগ্রাভিযানে দিনাজপুর অভিযানে এসেছিল তিনটি গ্রুপ। প্রথমটি ছিল টাইগার গ্রুপ। প্রায় আড়াইশ জনের এই কোম্পানিতে ইপিআর, মুজাহিদ, দেড়শজন আনসার ছাড়াও জর্জ গ্রুপের সদস্য ছিল প্রায় ৬০ জন। দ্বিতীয় কোম্পানিটি ছিল (এ কোম্পানি) বাংলাদেশ বাহিনীর। তৃতীয় কোম্পানিটির সবাই ছিলেন জর্জ গ্রুপের। এতে প্রায় ৪২১ জন মুক্তিসেনানি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর একসময়ে জর্জ ভাই জানিয়েছিলেন, তার গ্রুপের প্রায় ৫০ (পঞ্চাশ) সদস্য যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আহতদের সংখ্যা মাত্র এক।’ (পৃ. ১৩৬)

 

মুক্তিযুদ্ধের পর জর্জ দাশের নেতৃত্বে জর্জ বাহিনীর ছেলেরা দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাইন, গ্রেনেড, বোমা, পরিত্যক্ত অস্ত্র ও গালা উদ্ধারের কাজ করেন। দিনাজপুর শহরের মহারাজা স্কুলমাঠে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে জর্জ বাহিনীর অনেক সদস্যসহ প্রায় তিনশ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ইতিহাসে এটি দিনাজপুর ট্র্যাজেডি হিসেবে পরিচিত।

 

এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্ম দিনাজপুরের বিরল উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম পিটার ডি সি দাশ ও মা যোশেফিনা প্রীতি দাশ। সবার বড় ভাই জর্জ দাশের (৩২) পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর ছোট চার ভাইও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরা হলেন মি. জেমস এম দাশ (লুইস) (৩০), রবার্ট আর এন দাশ (২৭), জন এস কে দাশ (২৬) ও অ্যান্টনি এন এন দাশ (২১)। মি. লুইস দাশ কুঠিবাড়ীর যুদ্ধে জর্জ দাশের সহযোদ্ধা ছিলেন। তিনিও প্রাক্তন ইপিআরের একজন সৈনিক ছিলেন। তাঁর রেজি নং ছিল-১০৪৪৪। তিনি ঘুঘুডাঙ্গা যুদ্ধের সময় পায়ে শেলের আঘাতে আহত হন। জর্জ দাশের সহযোদ্ধা হিসেবেই তিনি যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা রবার্ট আর এন দাশ সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেননি। তিনি অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের কর্মী হিসেবে রিলিফ ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করছেন। জন এস কে দাশ ও অ্যান্টনি এন এন দাশ বিরলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। জর্জ দাশ বিরলযুদ্ধে অংশ নিলে তারা তার সহযোদ্ধার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে ১৫ জুন সকাল ১০টা ৪০-এ এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

সূত্র: এনটিভি