হালদায় নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ নিয়ে ধূম্রজাল

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

জোয়ার-ভাটার মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় রুইজাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালবাউশ) মা-মাছ সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের কাজে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

তবে হালদা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় মা-মাছের দেয়া সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।

হালদা নদীকে নিয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিতরা বলছেন, এ বছর হালদা নদীতে মা-মাছের দেয়া সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ, যা সংখ্যায় প্রকাশ করলে হবে প্রায় ৭ হাজার কেজি।

অথচ স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সরকারি হিসাব মতে, হালদায় মা-মাছের দেয়া সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ ১০ হাজার কেজি ছাড়িয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ রুহুল আমীন জানান, চলতি বছরে সরকারি ৬টি হ্যাচারির মধ্যে হাটহাজারী উপজেলায় ৩টি ও রাউজান উপজেলায় ২টি হ্যাচারি সচল আছে। তবে তার মধ্যে রাউজানের পশ্চিম গহিরা হ্যাচারিটির অবস্থা শোচনীয়।

এবার হাটহাজারী উপজেলার ৩টি সরকারি হ্যাচারিতে ৪০৮ বালতি (প্রতি বালতি গড়ে ১০-১২ কেজি নিষিক্ত ডিম ধারণ করতে পারে) সংগৃহীত নিষিক্ত মা-মাছের ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের জন্য রাখা হয়েছে। তার মধ্যে মদুনাঘাট হ্যাচারিতে ১৪২ বালতি, শাহ মাদারি হ্যাচারিতে ১৩৬ বালতি ও মাছুয়াঘোনায় হ্যাচারিতে ১৩০ বালতি।

এ ছাড়া রাউজান উপজেলার মোবারকখিল হ্যাচারিতে ৫৪ বালতি ও পশ্চিম গহিরা হ্যাচারিতে শুধু ৯ কেজি সংগৃহীত নিষিক্ত মা-মাছের ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের জন্য রাখা হয়েছে। সেই হিসাবে ৫টি হ্যাচারিতে সংগৃহীত নিষিক্ত মা-মাছের ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের জন্য রাখা হয়েছে ৪৬৩২ কেজি।

তিনি আরও বলেন, হাটহাজারী ও রাউজান এ দুই উপজেলায় সনাতন পদ্ধতিতে ১৩৯টি কুয়ায় সংগৃহীত নিষিক্ত মা-মাছের ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের জন্য রাখা হয়েছে প্রায় ৬৩২০ কেজি।

তার মধ্যে হাটহাজারী উপজেলার ৮০টি কুয়ায় রাখা হয়েছে ২৩১৫ কেজি ও রাউজান উপজেলার ৫৯টি কুয়ায় রাখা হয়েছে ৪০০৫ কেজি। এতে সরকারি হ্যাচারি ও মাটির কুয়া মিলে এবার সংগৃহীত নিষিক্ত মা-মাছের ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের জন্য রাখা হয়েছে ১০ হাজার ৯৫২ কেজি।

সবকিছু ঠিক থাকলে তা থেকে ৪-৫ দিন পর ১৮২ কেজি রেণু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব হ্যাচারি ও কুয়ায় ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের কাজে নিয়োজিত ডিম সংগ্রহকারীদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।

তবে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় দেরিতে ডিম দেয়া, ইঞ্জিনচালিত নৌযান ও ড্রেজারের পাখার আঘাতজনিত কারণে মা-মাছের মৃত্যু তথা সংখ্যা হ্রাস, নদীদূষণসহ নানা কারণে এবার আশানুরূপ ডিম পাওয়া যায়নি এমনটা দাবি করেছেন হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া।

তিনি বলেন, মাত্র ৭ হাজার কেজি ডিম পাওয়া গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তা থেকে চার দিন পর ১১৭ কেজি রেণু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ বছর আশানুরূপ ডিম পাওয়া না গেলেও ২০১৪ ও ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান চিন্তা করলে তা কিন্তু উৎসাহব্যঞ্জক। ওই দুই সালে তেমন একটা ডিম মেলেনি হালদায়।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হালদা নদীর পাড়ে সরেজমিন গেলে ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, হালদায় সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম তারা প্রথমে সনাতন পদ্ধতিতে মশারির নেট দিয়ে তৈরি এক বিশেষ ধরনের জাল পেতে নৌকায় তোলেন।

তার আগে নৌকায় তক্তা ও মাটি দিয়ে কৃত্রিম পুকুরের মতো তৈরি করে রাখা হয়। এই গর্তেই সুতির কাপড় দিয়ে তাতে ডিম রাখার ব্যবস্থা করে। এর পর নদীর তীরে মাটির তৈরি অগভীর কুয়ায় ছেড়ে দেন সংগৃহীত ডিম। ডিমকে কুয়ার মধ্যে পরিস্ফুটনের জন্য ৭-৮ মিনিট অন্তর অন্তর নড়াছড়া করতে হয়, যাতে ডিমগুলো ফোটানোর পর রেণুগুলো জালের নিচে পানির মধ্যে চলে যায়।

যখন দেখা যায়, রেণুগুলো জালের ওপর নেই তখন জাল ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে হয়। তারপর সদ্য রেণুগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করা জালে নিয়ে আরেকটি কুয়ার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়। নতুন কুয়ায় ছেড়ে দেয়ার ১৫-২০ মিনিট পর এই রেণুগুলোর চোখ ফোটে ও পূর্ণতা পায়। কিন্তু তখনও তাদের চেনা যায় না। এভাবে ৪-৫ দিন পর রেণুগুলো পরিপূর্ণতা লাভ করে।

অন্যদিকে গবেষণার কাজে নিয়োজিতদের হিসেবের সঙ্গে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সরকারি হিসেবে অমিল তথা টানপোড়নের ধূম্রজালকে কাজে লাগিয়ে হালদা পাড়ে কৃত্রিম রেণু পোনা উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা বেশ তৎপরতা চালাচ্ছে।

এতে করে প্রকৃত ডিম সংগ্রহকারীরা আতঙ্কে ভুগছেন। তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করেছে। এমনকি দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। পিকেএসএফের আওতাধীন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) হালদা প্রকল্পের প্রোগ্রাম অর্গানাইজার সাদ্দাম হোসেন জানান, হালদা পাড়ের হাটহাজারী ও রাউজান দুই উপজেলায় ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে নদীর মা-মাছ পাহারা দেয়া ও নজরদারির কাজ চলছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের জনসচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন ও মাটির কুয়া তৈরিসহ হালদা নদী থেকে সংগৃহীত ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের কাজে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এসব কুয়ায় ভালোভাবেই ডিম ফোটাচ্ছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

উল্লেখ্য, প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। এটি জোয়ার-ভাটা নদী, যেখান থেকে সরাসরি রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের পর পাহাড়ি ঢল নামলে হালদা নদীতে রুইজাতীয় মাছ ডিম ছেড়ে আসছে।

গত শনিবার মধ্যরাতে বৃষ্টি ও মেঘের গর্জনের ফলে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে নদীতে সৃষ্ট স্রোতে ডিম ছাড়ে রুইজাতীয় মা-মাছ। প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকলে সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম পরিস্ফুটনের মাধ্যমে উৎপাদিত রেণু আগামী ৪-৫ দিন পর থেকে হালদা পাড়ে শুরু হবে বিকিকিনির মহোৎসব।