হারিয়ে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ বই বিক্রেতারা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে বই বিক্রি করেই সংসার চলে যেত শাহজাহান মিয়ার। ২০ বছর ধরে এই পেশায় তিনি। বিজয় সরণি, সার্ক ফোয়ারা, শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান কিংবা শাপলা চত্বরে দাঁড়ালে দিন শেষে ঘরে নিয়ে যেতে পারতেন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা। কখনো কখনো আরো বেশি। বদলে গেছে সেই চিত্র। তাই বাধ্য হয়ে রাজধানী ছেড়ে দূর যাত্রার ট্রেন কিংবা লঞ্চ রুটে যেতে শুরু করেছেন। সদরঘাট থেকে মোংলাগামী এমভি মধুমতি লঞ্চে কথা হয় শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে। তাঁর বাড়ি শরীয়তপুরে। সংসারে রয়েছেন স্ত্রী আর স্কুলপড়ুয়া দুই সন্তান। সারা দিন কাজ করে বাড়ি যান। যেদিন একেবারে বিক্রি হয় না, সেদিন থেকে যান কমলাপুর স্টেশন বা কোনো বন্ধুর বাসায়। তিনি জানান, রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যালের চেয়ে দূরের যাত্রায় বই বেশি বিক্রি হয়। কারণ যাঁরা ভ্রমণ করেন—কখনো কখনো তাঁদের কিছু করার থাকে না, তাঁরা বই পড়েন। আবার বইয়ের দামের দিকেও লক্ষ করেন না। শাহজাহান মনে করেন, বইয়ের দামের কারণে পাঠক বইবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। যেসব বইয়ের এখন আর কোনো কপিরাইট নেই, সেই বইগুলো একেক প্রকাশনী একেক দাম নিচ্ছে। আবার সমান ফর্মার বই ও সাধারণ বইয়ের ক্ষেত্রে লেখক অনুযায়ী দাম বদলে যায়। যে কারণে পাঠক বই হাতে নিয়েও দাম দেখে ফিরিয়ে দেয়।

ফুটপাতে অনেক হকার আছে। কিন্তু বই বিক্রি সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন কাজ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা হাতের ওপর বই নিয়ে ঘুরতে হয়। সেই সঙ্গে পিঠে একটা বইয়ের ঝোলা তো থাকেই। রাতে যখন বাড়ি ফিরে ঘুমাতে যাই, তখন আমার হাত অবশ হয়ে আসে। মনে হয়, পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়েছি, বলেন শাহজাহান মিয়া।

পান্থপথ সিগন্যালে একই কথা বলেন তরিকুল। তিনি বলেন, পাঠক কমে যায়নি। সাহিত্যের পাঠক সব সময় একই রকম ছিল। পাঠ্য বই সবাই পড়ছে। কিছু মানুষ ধর্মীয় বই পড়ছে। সাহিত্যও পড়ছে। তবে একই বই একেক প্রকাশনী একেক দাম রাখছে বলে আমরা কিছু সমস্যায় পড়ছি। পাঠক হয়তো একটা বই আগেই দেখেছেন, অন্য প্রকাশনীর ছাপা একই বই আমার হাত থেকে নিয়ে যখন দেখছেন দাম ৫০ টাকার বেশি, তখন আর কেনেন না। আবার বইমেলা কিংবা প্রকাশকের কাছে গেলে তিনি ২৫ শতাংশ ছাড় দেন, কিন্তু আমরা তা দিতে পারি না। ধর্মীয় বই বিক্রি তুলনামূলক বেশি লাভজনক। সুন্দর ছাপা হলেই পাঠক সন্তুষ্ট, অন্য বিষয়গুলো নিয়ে অত বেশি চিন্তা করে না।

কথা হয় পরিবেশক ও আলীগড় লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জুম্মার সঙ্গে। তিনিও স্বীকার করেন বাজারে একই বইয়ের দাম একেক প্রকাশনী একেক রকম নিচ্ছে। একদিকে যেমন অতিরিক্ত মুনাফার আশায় বেশি নিচ্ছে, আবার কখনো কখনো বাধ্য হচ্ছে। তিনি মনে করেন, বাংলা একাডেমি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ২৫ শতাংশ ছাড় দেওয়ায় বইয়ের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ধরে নেওয়া যাক, একটি বইয়ের উৎপাদন খরচ ৯০ টাকা, প্রকাশক ১০ টাকা লাভ করে ১০০ টাকায় বিক্রি করবেন। কিন্তু মেলায় তাঁকে ২৫ শতাংশ ছাড় দিতে হবে বলে প্রকাশক বইটির গায়ে দাম লিখছেন ১২৫ টাকা। অথচ মেলা শেষ হয়ে গেলে পাঠক আর ২৫ শতাংশ ছাড় পাচ্ছেন না। তখন তাঁকে দেওয়া হচ্ছে ১০ বা ১৫ শতাংশ ছাড়। অর্থাৎ বাংলা একাডেমি পাঠক ঠকানোর পথ তৈরি করে দিচ্ছে।

তবে বাংলা একাডেমি বিষয়টি অন্যভাবে দেখছে। কর্তৃপক্ষ মনে করছে, মেলায় ২৫ শতাংশ ছাড় দেওয়ায় পাঠকরা উৎসাহী হচ্ছেন, বই বিক্রি বাড়ছে। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মোট ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে বাংলা একাডেমির বিক্রির পরিমাণ এক কোটি ৫১ লাখ টাকা। স্টল মালিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং মেলার শেষ দিনের (২৮ ফেব্রুয়ারি) বিক্রির তথ্য যোগ করে জানায় বাংলা একাডেমি। অর্থমূল্য বিবেচনায় ২০১৭ সালের তুলনায় সাত কোটি টাকার বই বেশি বিক্রি হয়েছে। ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৬ সালে ৪২ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ৯৫ লাখ এবং ২০১৪ সালে ১৬ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজক কমিটির সদস্যসচিব জালাল আহমেদ বলেন, ‘যে ঘটনাটি ঘটছে সেটা দুঃখজনক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, পুস্তক প্রকাশের একটি নীতিমালা থাকা উচিত। এখন কাগজের বাজার স্থিতিশীল। টেকনিক্যাল বই বা চার রঙে ছাপা বই ছাড়া বাকি বইয়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত হওয়া উচিত কত ফর্মা বইয়ের দাম কত হবে।’

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যারা বইমেলায় ২৫ শতাংশ ছাড় দেয়। সেটা শুধু পাঠকদের উৎসাহিত করার উদ্দেশে। এর সঙ্গে দামের সম্পর্ক অযৌক্তিক। বাংলা একাডেমিও ছাড় দিয়ে বই বিক্রি করছে। আমাদেরও প্রেস বিল থেকে শুরু করে সব খরচই আছে, যা অন্য প্রকাশকের থাকে। আবার আমরা লেখক রয়ালটি দিচ্ছি, বই বিক্রি করে লাভও করছি। বাংলা একাডেমি সাধারণত উৎপাদন খরচের দ্বিগুণ দাম নির্ধারণ করে একটি বইয়ের। এর মধ্যে লেখক রয়ালটি, প্রচারণা থেকে শুরু করে সবই থাকে। আবার বাংলা একাডেমি লাভও করছে। দেখার বিষয় হলো, পুনর্মুদ্রণে গিয়ে বইয়ের দাম কমে আসার কথা আবার দাম নির্ধারণে সাধারণ বইগুলোর ক্ষেত্রে ফর্মা অনুযায়ী দাম একই হওয়া উচিত—সেটা হচ্ছে কি না। পাঠক বঞ্চিত হওয়ার সঙ্গে মেলায় ছাড়ের কোনো সম্পর্ক নেই।