হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে কে লাভবান হলো

হরকাত আল-মুক্কাওয়ামা আল-ইসলামিয়া সংক্ষেপে হামাস একটি মিলিটারি সংগঠন, যার নাম শুধু গাজায় নয়; সমগ্র বিশ্বে এখন মুখে মুখে প্রচারিত। ইসরাইল সমর্থকরা বলেন, হামাস সন্ত্রাসী দল। আর ফিলিস্তিনবাসী ও সমর্থকদের কাছে এটি একটি ফিলিস্তিনি সংগঠন; যার সামরিক, বেসামরিক ও কূটনৈতিক শাখা আছে। হামাস পরিচালিত বহু জনহিতকর সংস্থা আছে, যা গাজায় মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।

২০২১ সালে মে মাসে দুসপ্তাহের হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে প্রথমবার হামাস ইসরাইলের অভ্যন্তরে রকেট হামলা চালিয়েছে; যার সিংহভাগ ইসরাইলের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ‘আয়রন ডোম’ প্রতিহত করতে পেরেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবার হামাস প্রমাণ করল-ইসরাইলের পৃথিবী অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করেও কিছু রকেট ইসরাইলের অভ্যন্তরে পড়েছে।

হামাসের বস্তুগত ক্ষতি গাজায় অনেক। ২০০ জনের বেশি প্রাণহানি ঘটেছে, যাদের মধ্যে ৬৪ জন শিশু। বস্তুত গাজায় প্রায় সবকিছু ধ্বংস করে ইসরাইল শান্ত হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইলের ১০ জন হতাহত হয়েছে। তবে হামাস যে ইসরাইলকে ট্যাংক, বিমান, আর্টিলারি ছাড়া মোকাবিলা করেছে-এটা অনেকটা মনস্তাত্ত্বি¡ক বিষয়।

হামাসের দুটি শাখাই বেশি প্রচারিত। একটি ‘দাওয়া’ বা Social Service শাখা, অন্যটি ইজ্জাত আল-দীন-আল-কাশিম বা সামরিক শাখা। ১৯৮৭ সালে গাজা এবং পশ্চিম তীরে ইসরাইলি দখলদারির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়, যা ‘ইন্তিফাদা’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। শেখ আহ্মেদ ইয়াসিন তখন উন্মোচন করেছিলেন কীভাবে ইসরাইল দখলদারি থেকে গাজা ও পশ্চিম তীর মুক্ত করা যায়; এমনকি ইসরাইলও মুক্ত করা যায়।

কারণ ইসরাইল ফিলিস্তিনবাসীদের উচ্ছেদ করা ভূমিতে সৃষ্ট দেশ। ২০০৭ সাল থেকে গাজার কর্তৃত্ব হামাসের হাতে আসে। মানুষ হামাসকেই তাদের প্রতিনিধি হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। হামাস ২০০৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করলে জাতিসংঘ, আমেরিকা, ইইউ, জাপান, রাশিয়া তাদের সাহায্য বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, কাতার হামাসকে সহায়তা দিয়ে আসছে।

৭০ দশকের শেষভাগ থেকে ইসলামিক ব্রাদারহুড তাদের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে গাজা ও পশ্চিম তীরে স্কুল, হাসপাতাল, সাহায্য কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে। গাজায় মসজিদ, মাদ্রাসা ও পশ্চিম তীরের বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৮৮ সালে হামাস তার নির্ধারিত নীতিতে প্রকাশ করে যে, ফিলিস্তিনি মুসলমানদের আবাসভূমি এবং তা কোনো মূল্যেই নন-মুসলিমদের কবজায় থাকতে দেওয়া যেতে পারে না। ইসরাইলের হাত থেকে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি (ধর্মীয়) দায়িত্ব বলেও হামাস ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে পিএলও ইসরাইলের রাষ্ট্র গঠন ও বেঁচে থাকার অধিকার আছে বলে মেনে নেয়।

১৯৯৬ সালে হামাস আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্মাণের জন্য তাদের একজন নেতা ‘খালিদ মেসালকে’ দায়িত্ব দেয়। হামাসের নেতারা প্রথমে জর্ডান, পরে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে বর্তমানে কাতারে তাদের (২০১২ সাল থেকে) সদর দপ্তর গড়ে তুলেছেন। এটি হামাসের রাজনৈতিক শাখা। মনে রাখা ভালো, হামাস প্রথম থেকেই ইসরাইলকে ভূমি ছেড়ে দেওয়ার কোনো আলোচনায়ই থাকতে চায়নি। ১৯৯৩ সালে ইসরাইল ও পিএলও’র মধ্যকার শান্তি চুক্তি তারা মানে না। হামাস এরই মধ্যে ইসরাইল ও তার স্বার্থে চোরাগুপ্তা হামলা ও ‘সুইসাইড অ্যাটাকের’ মতো আক্রমণও পরিচালনা করেছে।

পরে হামাস দুই রাষ্ট্রনীতি স্বীকার করে নেয়; তবে তা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পূর্ববর্তী সীমানায় রাষ্ট্র গঠন করা হলেই কেবল স্বীকার্য বলে মত প্রকাশ করে। ২০২১ সাল হামাস তথা ফিলিস্তিনের জন্য শুভ দিন। কারণ এ বছরই হামাস শুধু বিপদ ডেকে আনেনি; বরং তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের মতো স্পষ্টবাদী একজন নেতার সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন।

ইসরাইল পবিত্র রমজানে ‘লাইলাতুল কদর রাতে’ আল-আকসা মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলা করেছে। এতে মুসলিম নেতারা ব্যাথিত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলার নিন্দা করেছে। পবিত্র নগরী ‘জেরুজালেম ও মুসলমানের প্রথম কেবলা’ মসজিদুল আকসার পবিত্রতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইসরাইলকে একটি নিষ্ঠুর সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন এবং জেরুজালেমসহ আল-আকসা মসজিদ রক্ষায় আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। আর আমেরিকা ন্যাটোর নেতা। ইসরাইলকে কোনো দেশ প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলায় আমেরিকা ব্যাথিত হয়েছে। ইসরাইল একটি সন্ত্রাসী দেশ এবং জেরুজালেম নগরী রক্ষায় আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠনের দরকার-এ আওয়াজটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে কাতার, তেহরান ও দামেস্ক থেকে।

একবার ভাবুন, যদি প্রতিটি ওআইসি দেশ তাদের রাজধানী থেকে এ দাবিটি তোলে এবং জাতিসংঘে এটি নিয়ে আলোচনা করে; তবে বিশ্বজনমত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে দ্রুত মনোযোগী হবে। The New York Times পত্রিকা ২৯ মে তারিখে তাদের প্রথম পাতায় একটি করুণ ছবি প্রকাশ করে শিরোনাম দিয়েছে- ‘They were Just Children’। একেকটি লাইনে আট শিশু এবং ৮টি লাইনে নিহত ৬৪ শিশুর এ ছবি কঠিন হৃদয়ের মানুষের মনেও বেদনার উদ্রেক করবে।

প্রশ্ন জাগে, মাত্র কয়েকদিনের যুদ্ধে নির্বিচার বোমা হামলায় ইসরাইল যে ৬৪ শিশুকে হত্যা করল, এটা কি সন্ত্রাসী দেশের কাজ নয়? এটা কি আত্মরক্ষার নমুনা! ইসরাইল যে প্রতিশোধ নিচ্ছে, তা কি ইসরাইলের জন্য হিতকর হচ্ছে; নাকি নেতানিয়াহু তার জনপ্রিয়তা বাড়াতে উগ্র ইহুদিদের সমর্থন লাভের আশায় ও তার প্রধানমন্ত্রিত্ব পদে টিকে থাকবার ইচ্ছাতেই এটি করেছিলেন? মনে রাখতে হবে, নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন থেকে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার বিচার কাজ দীর্ঘায়িত ও দায়মুক্তি নিয়ে হাঁটতে চেয়েছেন।

রমজান মাসে ইসরাইল কর্তৃক ‘দামাস্কাস গেটে’ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, ‘শেখ জাররা’ এলাকা থেকে বেশ কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদ করা, ইহুদিদের আল-আকসা মসজিদে অনুপ্রবেশ ইত্যাদি ইসরাইলের অভ্যন্তর ও ফিলিস্তিন এলাকায় ব্যাপক জনরোষের সূত্রপাত ঘটায়। ইসরাইলের এসব উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য হামাস সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দায়েফ ইসরাইলকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে বলে হুমকি দিয়েছেন। এতে সাধারণ মানুষ হামাসের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন প্রদান করেছে।

ইসরাইল ইচ্ছা করে ঘটনাটি সাজিয়েছে কি না, তা পরে হয়তো প্রকাশ পাবে। তবে জনগণ যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, তা অকল্পনীয় এবং ১৯৪৮ সালের পর এবারই প্রথম ফিলিস্তিন এত বোমা, রকেট, ট্যাংক, আর্টিলারি, বিমান হামলা সহ্য করেও রকেট ছুড়ছে। এবারের রকেটগুলো অন্যবারের তুলনায় আধুনিক। হামাস এবার ড্রোন ব্যবহার করেছে, যা যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অধিকৃত এলাকার মানুষ এখন হামাসে বিশ্বাস স্থাপন করতে শুরু করেছে।

ইসরাইলের জন্য এটি অশনিসংকেত। অধিকন্তু, হামাসের সঙ্গে ইসরাইল যখন যুদ্ধে লিপ্ত, তখন ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ইসরাইল সামরিক বাহিনীর সঙ্গে পশ্চিম তীরে তার বাহিনীর নিরাপত্তা বিষয়ে পরস্পর সমঝোতা করছিলেন। এতে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন জনগণ তাদের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে আমেরিকার দালাল ও ইসরাইলের collaborator বলে উল্লেখ করেছে।

এসব ঘটনাপরম্পরায় এটুকু বলা যায়-ইসরাইল গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তাদের দেশের ভালোর জন্য নয়, নেতানিয়াহুর ভালোর জন্য। আর হামাস এ যুদ্ধে আরও শক্তি অর্জন করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হামাস কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করল-তারাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য সংগঠন, যারা জেরুজালেমকে মুক্ত করতে পারে, ইসরাইল কর্তৃক ক্রমাগত ফিলিস্তিনিদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ রোধ করতে পারে আর নিজেরা জীবন দিয়েও ইসরাইলকে সমুচিত শিক্ষা দিতে পারে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের জনগণ যেভাবে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সদা ব্যস্ত ও প্রতিহত করেছিল, তা ছিল বিস্ময়কর; অনেকের চিন্তারও অতীত। আর কোনো প্রথাগত সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ছাড়া হামাসের প্রতিরোধ আন্দোলন ও পারমাণবিক অস্ত্রধারী, আধুনিক সমরসম্ভারে সজ্জিত ইসরাইলকে প্রত্যুত্তর ও চিন্তায় ফেলে দেওয়া নিঃসন্দেহে একুশ শতকের একটি বড় ঘটনা।

অন্যদিকে দীর্ঘ ৭০ বছর পর এই প্রথম ইউরোপ-আমেরিকা বলতে শুরু করেছে ইসরাইলি বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের কথা। আমেরিকায় ‘Black lives matter’ আন্দোলন স্বীকৃতি পেয়েছে। ফিলিস্তিনে ‘Palestanian lives matter’ আন্দোলনও বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান করে নিয়েছে। ইসরাইলি একতরফা উচ্ছেদ অভিযান থেকে মুক্ত হয়ে সম্মানের সঙ্গে নিজস্ব ভূখণ্ডে শান্তিতে বসবাস ও বাঁচার আকুতি যে ফিলিস্তিনি জনগণের; তা বিশ্ববিবেককে বেশ নাড়া দিয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম : তুরস্কে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সামরিক অ্যাটাশে

jahangir010754@gmail.com

 

সূত্রঃ যুগান্তর