স্মৃতিতে অম্লান তাঁরা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

চলে গেল আরও একটি বছর। শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক তারকা এ বছর চলে গেলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁরা ছিলেন দর্শক-ভক্ত-শ্রোতার আগ্রহের কেন্দ্রে। আলোড়ন তোলা প্রয়াত সেসব তারকাদের নিয়ে প্রথম আলোর আয়োজন ‘স্মৃতিতে অম্লান তাঁরা’। আজ থাকছে ক্যামেরার সামনের ও পেছনের প্রয়াত এ শিল্পীদের। জানাচ্ছেন শরীফ নাসরুল্লাহ

আব্বাস কিয়ারোস্তামিআব্বাস কিয়ারোস্তামি
পুরো পৃথিবী জানে তাঁর অসাধারণ কর্মের কথা। তাঁর মাধ্যমেই ইরানি ছবি আন্তর্জাতিক সুনাম পেয়েছে। তিনি চলচ্চিত্রের ভাষা পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন, চলচ্চিত্রকে করে তুলেছিলেন আরও মানবিক, বলেছেন ইরানের বিখ্যাত পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফের।

কিয়ারোস্তামির জন্ম ১৯৪০ সালে তেহরানে। মারা যান ২০১৬ সালের চার জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় পড়ালেখার পর গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ইরানিয় টেলিভিশনের কমার্শিয়ালে। ১৯৬৯ সালে তিনি যোগ দেন দ্য সেন্টার ফর দ্য ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ং অ্যাডাল্টে (কানুন)। সেখানকার চলচ্চিত্র বিভাগটি দেখভাল করতেন তিনি। সেখানে যোগ দেওয়ার পর থেকে​ই ছবি বানাতে শুরু করেন কিয়ারোস্তামি। ২০০৫ সালে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘শুরুতে শিশুতোষ সমস্যা নিয়ে চলচ্চিত্রগুলো করা হতো। সেটা ছিল আমার চাকরির অংশ। কিন্তু এই কাজই আমাকে শিল্পী করে তুলেছে।’

কিয়ারোস্তামির প্রথম ছবি ‘দ্য রিপোর্ট’ নির্মিত হয় ১৯৭৭ সালে। ১৯৯৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর অনেক শিল্পীই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু কিয়ারোস্তামি তখন ইরানেই থেকে গিয়েছিলেন এবং নতুন সরকারের কঠোরতার মধ্যেই নিজের কাজ করে গেছেন। আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত তাঁর ট্রিলজি ‘হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম’ (১৯৮৭), ‘লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর…’ (১৯৯২) ও ‘থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ’ (১৯৯৪) নির্মাণ করেন। এই ট্রিলজি কখনো বাস্তব, কখনো কল্পনার পথ ধরে চলেছে, কখনো বিবরণ, কখনো তথ্য প্রকাশ-নির্মাণের এই বৈচিত্র্য তখনই বুঝিয়ে দিয়েছে, আব্বাস কিয়ারোস্তামির কাজকে ইচ্ছে করলেই কোনো ছাঁচে ফেলা যাবে না কিংবা কোনো তকমা দেওয়া যাবে না।

১৯৯৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘স্বর্ণ পাম’ জিতে নেয় কিয়ারোস্তামির ছবি ‘টেস্ট অব চেরি’। দুই বছর পর ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি পুরস্কার জেতেন ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’ ছবির জন্য। তাঁর সাম্প্রতিক ছবিগুলোর মধ্যে আছে ‘সার্টিফায়েড কপি’ ও ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’। তার চেয়েও বড় কথা, আব্বাস কিয়ারোস্তামি সেই বিরল নির্মাতাদের একজন, যিনি শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েও তাঁর দেশের সিনেমাকে নিয়ে গেছেন অনেক দূর।
ক্যারি ফিশারক্যারি ফিশার
‘স্টার ওয়ারস’ সিরিজের ছবিগুলোতে প্রিন্সেস লেইয়ার কথা মনে আছে? বাস্তবে তিনি ক্যারি ফিশার। জনপ্রিয় এই হলিউড অভিনেত্রী মারা গেছেন ২৭ ডিসেম্বর। ফিশারের জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে ১৯৫৬ সালে। অভিনয় জীবনে ফিশার ‘স্টার ওয়ারস’ সিরিজের ছবি ছাড়া আরও অনেক ছবি করেন। কিন্তু এই সিরিজের সিনেমাগুলোই তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯৮০ সালে তিনি পানাসক্তির সঙ্গে লড়াই শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘পোস্টকার্ডস ফ্রম দ্য এজ’ লেখার মধ্য দিয়ে আবার সৃজনশীল কাজে ফিরে আসেন। পরে এটি চলচ্চিত্রে রূপ পায় সেখানে অভিনয় করেন মেরিল স্ট্রিপ। এ বছরেই হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে ফিশারের বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
ডেবি রেইনল্ডডেবি রেইনল্ড
মেয়ে ক্যারি ফিশার হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যুর একদিন পরই মারা গেলেন তাঁর মা, ডেবি রেইনল্ড। ডেবির বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে—এই আশঙ্কায় ২৮ ডিসেম্বর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি হাসপাতালে। হাসপাতালে নেওয়ার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তিনি মারা যান।

এ যুগের খুব কম মানুষই তাঁকে চিনবেন। হলিউডের পুরোনো ছবিগুলো দেখলে মনে পড়বে তাঁকে। ‘সিংগিন ইন দ্য রেইন’ ছবিটির কথা মনে হলেই ডেবির চেহারা ভেসে ওঠে। চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগের একজন চালচুলোহীন অভিনেত্রী কীভাবে দর্শকের ভালোবাসা জয় করল, তা ভাবাবে দর্শককে।

১৯৩২ সালের পয়লা এপ্রিল জন্ম হয়েছিল মেরি ফ্রান্সেস রেইনল্ডের। ১৬ বছর বয়সেই ‘মিস বারব্যাংক সুন্দরী’ প্রতিযোগিতায় তাঁকে দেখে চলচ্চিত্র কোম্পানি ওয়ার্নার ব্রাদার্স তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়। তাঁরাই নাম বদলে তাঁর নাম রাখে ‘ডেবি’। অভিনয় করেন ‘জুন ব্রাইড’ ছবিতে। ১৯৫০ সালে তিনি মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। সে বছরেই তাঁর প্রথম ছবি ‘দ্য ডটার অব রোজি ওগ্রাডি’ মুক্তি পায়। এরপর ১৯৫২ সালে ‘সিংগিন ইন দ্য রেইন’। ডেবি তারকা বনে যান। ডিক পাওয়েলের সঙ্গে ‘সুসান স্লেপ্ট হেয়ার’, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার সঙ্গে ‘দ্য টেন্ডার ট্র্যাপ’, স্বামী এডি ফিশারের সঙ্গে ‘বান্ডেল অব জয়’, টনি র‍্যান্ডেলের সঙ্গে ‘ইট স্টারটেড উইথ এ কিস’ ছবিগুলোতে অভিনয় করে নাম ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। গান নিয়েও কৃতিত্ব ছিল তাঁর। ১৯৫৭ সালে ‘ট্যামি অ্যান্ড দ্য ব্যাচেলর’ ছবিতে ‘ট্যামি’ গানটি গেয়েছিলেন, যা ছিল সিঙ্গল চার্টের নাম্বার ওয়ান। ১৯৭০ সালে ‘হোয়াটস দ্য ম্যাটার উইথ হেলেনই বড় পর্দায় তাঁর শেষ ছবি।
অ্যালান রিকম্যানঅ্যালান রিকম্যান
‘হ্যারি পটার’ সিরিজের ‘প্রফেসর স্নেপ’ বলেই বেশি পরিচিত তিনি। যদিও অ্যালান রিকম্যানের জনপ্রিয় হয়েছিলেন প্রথম ছবি ‘ডাই হার্ড’ দিয়েই। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেলেন ব্রিটিশ অভিনেতা অ্যালান রিকম্যান। ৬৯ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর।

‘ট্রুলি ম্যাডলি ডিপলি’ ছবিতে জুলিয়েট স্টিভেনসনের অশরীরী প্রেমিক এবং ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিটিবিলিটি’ ছবিতে কেট উইন্সলেটের বিপরীতে কর্নেল ব্র্যান্ডনের ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি বাফটা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তবে পুরস্কার মেলে ‘রবিন হুড: প্রিন্স অব থিভ্স’ ছবিতে নটিংহামের শেরিফের চরিত্রে অভিনয় করে। ‘রাসপুতিন’-এর চরিত্র অভিনয় করে পেয়েছিলেন গোল্ডেন গ্লোব।

ব্রিটিশ অভিনেতা রিকম্যানের জন্ম ইংল্যান্ডের পশ্চিম লন্ডনে ১৯৪৬ সালে। অভিনয় জীবনের শুরুটা হয়েছিল রয়েল শেক্‌পিয়ার কোম্পানিতে। এরপরেই তিনি রুপালি পর্দায় পাড়ি জমান। ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
আন্তন ইয়েলচিনআন্তন ইয়েলচিন
এ বছরের ১৯ জুন নিজের গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলে ‘স্টার ট্রেক’ তারকা আন্তন ইয়েলচিনকে। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে তাঁর নিজের বাড়ির সামনেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। ইয়েলচিন বন্ধুদের সঙ্গে মহড়ায় অংশ নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও আন্তন মহড়ায় উপস্থিত না হওয়ায় বন্ধুরা খোঁজ নিতে তাঁর বাড়িতে আসেন। এরপর বাড়ির সামনে তাঁর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।

১৯৮৯ সালে রাশিয়ার লেলিনগ্রাদে ইহুদি পরিবারে জন্ম হয় ইয়েলচিনের। নয় বছর বয়সে স্বাধীন চলচ্চিত্র ‘আ ম্যান ইজ মোস্টলি ওয়াটার’ দিয়ে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু হয়। যদিও তিনি বেশি জনপ্রিয় হন ‘স্টার ট্রেক’ সিরিজের ছবিগুলোয় অভিনয় করে। রুপালি পর্দা ছাড়াও তিনি টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হচ্ছে ‘আলফা ডগ’, ‘টারমিনেটর সালভেশন’, ‘গ্রিন রুম’ ইত্যাদি।

সূত্র: বাংলাট্রি্িবিউন