স্বাস্থ্য বিভাগের সব কাজেই স্বাচিপের বাগড়া খবরদারি থেকে মুক্তি চান চিকিত্সকরা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

নিয়োগ থেকে বদলি, পদোন্নতি থেকে পদায়ন সবখানেই খবরদারি স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ)। কেনাকাটা থেকে শুরু করে ঠিকাদারি পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে স্বাচিপ নেতারা ক্ষমতা দেখান না। তাদের কথার ব্যত্যয় হলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হয়ে যান ‘জামায়াত শিবিরের’ লোক। ফলে তাদের ভয়ে তটস্থ থাকেন চিকিত্সকরা। এই ধরনের খবরদারি বিএনপি-জামায়াত জোট আমলেও ছিল। তখন ছিল ডক্টর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। তখন তাদের ভয়ে দিন কাটত চিকিত্সকদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সকল কাজে হস্তক্ষেপ করছেন স্বাচিপের এক শ্রেণীর নেতা ও কর্মীরা। এতে করে সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য- পেশার মান বাড়ানোর কাজ বাদ দিয়ে সারাদিন তারা তদ্বির নিয়েই ব্যস্ত। চিকিত্সা পেশায় যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। তবে স্বাচিপ নেতারা অযোগ্যদের নিয়োগ, পদোন্নতি, কেনাকাটাসহ নানা কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। সঙ্গে অযৌক্তিক তদবির তো আছেই।

রাজধানীর ৭টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সকল কাজেই বাগড়া দেয় স্বাচিবের একশ্রেণির নেতা ও কর্মী। তাদের বাড়াবাড়ি বিরক্তির পর্যায়ে পড়েছে। আগে ড্যাবের নেতারাও একইভাবে বিরক্ত করতেন। তাই এধরনের সংগঠন না রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন অনেকে। তারা বলছেন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নামে চিকিত্সকদের একটি জাতীয় সংগঠন রয়েছে। এটি ছাড়া বাকি সংগঠনের কোনো দরকার নেই। শুধু হাসপাতাল নয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও নার্সিং অধিদফতরেও চলছে স্বাচিপ নেতাদের দাপট। নার্সিং অধিদফতরের কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও স্বাচিপ নেতাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন এই অবৈধ বাণিজ্যে।

এই সরকার চিকিত্সা ব্যবস্থাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশেষ করে বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি চিকিত্সা বিশ্বের যে কোনো দেশের সমতুল্য। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতাল শিশু মুক্তামনির অপারেশন করতে অপারগতা প্রকাশ করে। অথচ আমাদের চিকিত্সকরাই তার হাত রেখেই সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন অপারেশন। সরকার বিভাগীয় শহরেও মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সিসিইউ, আইসিইউ’র ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিকিত্সা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করেছে সরকার। বিশেষায়িত চিকিত্সা আরো উন্নত করেছে।

একজন সিভিল সার্জনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন একজন সিনিয়র মন্ত্রী। ওই সিভিল সার্জন বৈকালিক বহির্বিভাগ চালু করেছিলেন। এতে ওই এলাকার মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। মন্ত্রীর সুপারিশ ছিল ওই সিভিল সার্জনকে অন্তত এক বছর রেখে দিলে তিনি পুরো জেলার সবগুলো উপজেলায় বৈকালিক বহির্বিভাগ চালু করবেন। যেটা স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য একটা মডেল হবে। সংশ্লিষ্ট ওই জেলার বাসিন্দা অপর একজন সিনিয়র মন্ত্রীও ওই সিভিল সার্জনের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করেন। অথচ স্বাচিপের কতিপয় নেতা পছন্দের লোক নিয়োগ দিতে ওই সিভিল সার্জনকে ‘জামায়াত-বিএনপি’র তকমা লাগিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্ট এলাকার ওই সিনিয়র মন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন, ওই সিভিল সার্জনের বাবার সঙ্গে তিনি একসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে থেকে রাজনীতি করেছেন। এই পরিস্থিতিতে ওই সিভিল সার্জনকে এখন আর ‘জামায়াত-বিএনপি’ না বানাতে পেরে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশের পরও গত প্রায় আট মাস ধরে ফাইল আটকে রাখা হয়েছে।

শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের কিছু সরঞ্জাম স্বাচিপের কয়েক নেতার মাধ্যমে কেনার চাপ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ১৪ জন প্লাস্টিক সার্জনকে সহযোগী অধ্যাপক করার প্রস্তাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে গেছে। স্বাচিপের কয়েকজন নেতা বলেছেন, তাদেরকেও পদোন্নতি দিতে হবে। অথচ তাদের অনেকেই এখনো সহকারী অধ্যাপকও হননি। কেউ কেউ সহকারী অধ্যাপক হলেও অনেক জুনিয়র। এসব কারণে তাদের পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া এই ১৪ জন চিকিত্সক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করছেন। কোনো কিছু না পেরে এখন তাদের ‘বিএনপি-জামায়াত’ বলে প্রচার করছে। যাদের পদোন্নতি ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে একজন স্বাচিপের আজীবন সদস্য (নম্বর-১৭৮৬)। তাকে এখন বলা হচ্ছে জামাতের লোক। অথচ বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সময় এরা ইতিবাচক দায়িত্ব পালন করেছেন। একইভাবে স্বাচিপের বাড়াবাড়ির কারণে বিভিন্ন বিষয়ে দুই শতাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের বিভাগীয় পদোন্নতি আটকে আছে।

স্বাচিপের মহাসচিব ডা. এম. এ. আজিজ বলেন, ‘স্বাচিপের নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ এমন ঘটনা ঘটালে আমরা তদন্ত করব। সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেই না।’

স্বাচিপের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সনাল বলেন, ‘ঢাকার একটি মেডিক্যালের অধ্যক্ষ অভিযোগ দিয়েছেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের বিষয়টিও আমরা অবহিত হয়েছি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলছেন, চিকিত্সকদের স্বাচিপ বা ড্যাবের নামে দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের সংগঠনের অস্তিত্ব নেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা স্বাচিপের এই বাড়াবাড়ি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সূত্র: ইত্তেফাক