স্বাস্থ্য খাতে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি পেছনের রুই-কাতলাদের বিরুদ্ধেও

দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগে দেশে গত এক সপ্তাহে ১০টি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন সারা দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিককে কঠোর নজরদারির আওতায় আনার কথা বলা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেছেন, সব হাসপাতাল, ক্লিনিক, ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় তদারকির জন্য জেলায় জেলায় সিভিল সার্জনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জেকেজি এবং রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ প্রতারণার নানা অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে সরকার যে সব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব – এই নিয়ে এখন তুমুল আলোচনা চলছে।

জেকেজি হেলথ-কেয়ার এবং রিজেন্ট হাসপাতালের কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের লাইসেন্স না থাকার অভিযোগও সামনে এসেছে।

এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকায় এক সপ্তাহে ১০টি বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে বেশিরভাগেরই লাইসেন্স নবায়ন না করা এবং নানা অনিয়মের তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছে।

স্বাস্থ্যখাতের পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মুখে সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসায় প্রতারণা ঠেকাতে সারা দেশে নজরদারির ব্যবস্থা করার কথা বলা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলেছেন, দেশের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে নজরদারির আওতায় আনার জন্য তিনি মঙ্গলবার সিভিল সার্জনদের চিঠি দিয়েছেন।

আব্দুল মান্নান বলেন, ‘শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক নয়, সারা দেশেই উপজেলা পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক বা অবৈধভাবে স্বাস্থ্যখাতে অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। এই প্রত্যেকটি জায়গার আমরা খোঁজখবর নেব এবং নজরদারিতে আনব।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আরো বলেন, ‘আজই আমি চিঠি দিয়েছি সব সিভিল সার্জনকে। তাঁরা গ্রামপর্যায় পর্যন্ত হাসপাতাল ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স আছে কি-না বা চিকিৎসা অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হচ্ছে কি-না, এবং কোনো অনিয়ম আছে কি-না, এসব দেখবেন।’

সরকারি হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে ১৫ হাজারের মতো বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে চার হাজার ১৬৪টির লাইসেন্স আছে এবং এই লাইসেন্সধারীদেরও মাত্র দুই হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্স নবায়ন করেছে।

দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, লাইসেন্স ছাড়াই হাসপাতাল ক্লিনিক চালানোসহ স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটা এবং চিকিৎসায় অনিয়ম একটি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে। এখন দৃশ্যমান কিছু ঘটনায় সরাসরি জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পেছনের রুই-কাতলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে কোনো ফল হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ ধরনের দুর্নীতি এক হাতে হয় না। এটি ‘উইন-উইন গেম’। এখানে সাধারণত তিনটি পক্ষ থাকে। ঠিকাদারি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারক চক্র আছে। তাদের সুরক্ষা দেয় প্রশাসনের একাংশ, যারা কাগজপত্র প্রক্রিয়াজাত করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় আরো উচ্চতর প্রভাবশালী মহল। এর বিভিন্ন দৃষ্টান্ত প্রকাশ পাচ্ছে। সেখানে রুই-কাতলাদের না ধরে নীচের দিকের ব্যবস্থা নিয়ে ইতিবাচক কিছু হবে না।

করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রথমদিকে চিকিৎসা না পাওয়া এবং এখন অনিয়ম দুর্নীতির নানা অভিযোগ ওঠায় হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যখাত নিয়ে মানুষের মাঝে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রীদেরও অনেকে এখন তা স্বীকার করেন।

বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, যেহেতু অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে পেছনের শক্তিকে চিহ্নিত করার পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান নয়। সেজন্য অনিয়মে সরাসরি জড়িত বা প্রকাশ্যে থাকা কিছু লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা যে নেওয়া হচ্ছে, তা লোক দেখানো কিনা- এমন সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. শাহনাজ হুদা বলছেন, ‘যেটা বার বার বলা হচ্ছে যে মন্ত্রণালয়ের একটা সিন্ডিকেট আছে- যেটা সবাই বলছেন। অবশ্যই তাঁদের উচ্চপর্যায়ের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। এটি যদি আমরা না ধরতে পারি, তাহলে স্বাস্থ্যখাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে না।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী আ ফ ম. রুহুল হক বলেন, ‘মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এখন অনিয়ম দুর্নীতির পেছনের শক্তিকে চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের এমনিতেই অনাস্থা আছে, সেটি আরো  বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘এখনকার অভিযোগগুলোর সঙ্গে  পেছনের শক্তিকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব যারা তদন্ত করছেন  তাদের। যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখন প্রতিদিন এগুলোর ফলো-আপ করছেন। সুতরাং তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।’

এদিকে, দুদকের সচিব দিলওয়ার বখত বলেছেন, স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে দুদক যে অনুসন্ধান করছে, তাতে আদালতে প্রমাণ-যোগ্য তথ্য যা পাবে, তার ওপর ভিত্তি করে দুদক এগুবে।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ