স্বপ্নের টানেলে এক নগরীতে দুই শহর

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

চীনের ওয়াংপু নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে আছে এশিয়ার বিখ্যাত সাংহাই নগরী। মাঝখানে ওয়াংপু নদী। এক তীরে পুডং, অপর তীরে পুশি শহর।

 

ঠিক ‘সাংহাই সিটি’র আদলে গড়ে তোলা হবে স্বপ্নের চট্টগ্রাম সিটি। মাঝখানে কর্ণফুলী নদী। এক পাশের তীর ঘেঁষে এখনকার চট্টগ্রামের মূল শহর। অপর পাড়ের কয়েকটি উপজেলা নিয়ে বিকল্প আরেকটি শহর গড়ে উঠবে।

 

ভাবতে পারেন কি করে সম্ভব? এক চট্টগ্রামে দুটি শহর, মাঝখানে নদী। এমন অসম্ভব স্বপ্নই পূরণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বপ্ন পূরণে সরকার কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে দীর্ঘ সাড়ে তিন কিলোমিটার বহুলেন বিশিষ্ট একটি ট্যানেল নির্মাণ করবে। চীনের অর্থ সহায়তায় নির্মিত হবে এই টানেল। এই টানেল যুক্ত করবে দুই শহরকে।

 

সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্বপ্নের টানেল নির্মাণে শুক্রবার চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর উপস্থিতিতে চুক্তি সম্পাদিত হবে প্রকল্পের অর্থযোগানদাতা চীনের এক্সিম ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের সেতুবিভাগের মধ্যে।

 

শুক্রবার রাজধানী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্প’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।

 

এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘চীনের সাংহাই সিটির মতো এক সিটিতে চট্টগ্রাম নগরীতে পরিকল্পিত দু্টি শহর গড়ে তুলতে চায় সরকার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদাও পূরণ হলো।’

 

মন্ত্রী জানান, শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশে সফররত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে প্রকল্পকাজের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। এই বছরেই নির্মাণ কাজ শুরু হবে। নির্ধারিত সময়ে (চার বছর) নির্মাণকাজ শেষ হবে।

 

তিনি আরো জানান, দুই কিলোমিটার নিম্ন স্রোত থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।  টানেলটি একই সঙ্গে ন্যাশনাল হাইওয়ে ও এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।

 

Tunnel

 

নগরীর নেভাল একাডেমি থেকে কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার) পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণ করা হবে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, কর্ণফুলী নদীর ওপর বর্তমানে দুটি ব্রিজ রয়েছে। এতে নদীতে প্রতিনিয়ত সিলটেশন (পলি জমা) হচ্ছে। নদীর নাব্যতা রক্ষার স্বার্থে আরেকটি ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব নয়। আরেকটি ব্রিজ নির্মাণ করলে বন্দর ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্রিজ নির্মাণ না করেই টানেল নির্মাণের মাধ্যমে বন্দরের স্বাভাবিক কাযক্রম ঠিক রাখা হবে। টানেল হলে বন্দরের কাজে গতিশীলতা বাড়বে। দ্রুত মালামাল বন্দরে ঢুকতে পারবে।

 

তিনি বলেন, টানেল নির্মিত হলে ওই পাড়ে গড়ে উঠবে আরেকটি শহর। যেখানে শিল্প কারখানাসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমও নদীর ওপারে সম্প্রসারিত হবে। স্বাভাবিকভাবে নগরীর উত্তরাংশের ওপর চাপ কমবে।

 

সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগ জানায়, প্রকল্পকাজের শুভ উদ্বোধন হলেও কর্মযজ্ঞ শুরু হবে ডিসেম্বর। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ইফতিখার কবির বলেন, ‘আশা করছি, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু করতে পারব।’

 

যথাসময়ে কাজ শেষ করা যাবে কি না- জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘কমার্শিয়াল অ্যাগ্রিমেন্টে প্রকল্প মেয়াদ আসলে পাঁচ বছর। চুক্তিমতে ইতিমধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে। আমরা চাই বাকি চার বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করতে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ সময়ে শেষ করা সম্ভব।’

 

নদীর তলদেশে টানেল বাংলাদেশে এই প্রথম। এটা কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত তা জানা না গেলেও বাংলাদেশে নির্মিত বড় বড় ব্রিজের চেয়েও বেশি টেকসই হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।

 

তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পে বড় বড় ব্রিজ ভেঙে গেছে এমন দৃষ্টান্ত অনেক, তবে টানেল ওইভাবে ভেঙে পড়ার ঘটনা আমার জানা নেই। বিশ্বে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে টানেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এমন নজির নেই।’

 

চট্টগ্রাম হবে- টু টাউন ওয়ান সিটি

স্বপ্নের টানেল নির্মিত হলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম হবে টু টাউন ওয়ান সিটি। ঠিক চীনের বিখ্যাত সাংহাই নগরীর মতো।

 

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, একদিকে কাপ্তাই, আরেকদিকে কর্ণফুলী-আনোয়ারা-বাঁশখালী উপূকল এলাকা। মাঝখানে বয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী। এপার থেকে ওইপারে যাওয়ার জন্য রয়েছে দুটি ব্রিজ। এই মুহূর্তে নদীতে আরেকটি ব্রিজ নির্মাণে সুযোগ নেই। করতে গেলে নদীর সমস্যা হবে। জাহাজ ঢুকতে পারবে না। এ কারণে নদীর এত কাছে হওয়ার পরও কর্ণফুলী ও আনোয়ারা এলাকার দিকে শহরটি সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। এই টানেল নির্মিত হলে- এই পারের তিনটি থানার উপকূলীয় এলাকা নিয়ে গড়ে উঠবে আরেকটি শহর। যেখানে স্থাপিত হবে নতুন নতুন কলকারখানা। সুযোগ সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। টানেলটি যুক্ত করবে দুটি শহরকে।

 

Tunnel

 

টানেল হলে যত সুবিধা : সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটি নির্মিত হলে বন্দরের সুবিধা বাড়বে। এখন শহরের উপর দিয়ে মালামাল নিয়ে বন্দরে ঢুকতে হয়। টানেল হলে আউটার রিংরোড ধরে সোজা টানেল হয়ে খুব দ্রুত বন্দরে ঢুকে পড়বে মালামালবাহী পরিবহণ। এতে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। চাপ কমবে মূল শহরের।

 

এই টানেলের ফোরলেন মহাসড়ক ধরে দ্রুত শহর থেকে বের হওয়া যাবে। একইভাবে কক্সাবাজার থেকে দ্রুত টানেল হয়ে চট্টগ্রামের মূল শহরে প্রবেশ করা যাবে। এতে সব চেয়ে বড় সুবিধা পাবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের লাখ লাখ মানুষ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব কমে যাবে।

 

সেতু বিভাগ জানায়, টানেল নির্মাণে ব্যয় হবে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা। দুই লেন বিশিষ্ট টানেলের উভয়পাশে আরো দেড় কিলোমিটার করে সংযোগ সড়ক থাকবে। টানেল দিয়ে চলাচলকারী যানের গতি হবে ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। টানেলটি এশিয়ান হাইওয়ে ও ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে।

 

১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান সিসিসি এবং হংকংয়ের অরূপ নামের দুইটি প্রতিষ্ঠান টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে অ্যালাইনমেন্ট তৈরি করেছে। জি টু জি’র (সরকার থেকে সরকার) মাধ্যমে টানেল নির্মাণ করা হবে।

 

তারা প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য তিনটি স্থান প্রাথমিকভাবে বাছাই করে। তা হলো-  এলাইনমেন্ট ‘এ’ পোর্ট কানেকটিং রোড, এলাইনমেন্ট ‘বি’ সিমেন্ট ক্রসিংয়ের নৌবাহিনী ঘাঁটি সংলগ্ন এলাকা এবং এলাইনমেন্ট ‘সি’ সিইউএফএল-কাফকো সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর মোহনা।

 

এর মধ্যে এলাইনমেন্ট ‘সি’ নেভী কলেজের পাশ দিয়ে যাবে। এখানে মূল টানেল হবে তিন হাজার ১৪০ মিটার। পশ্চিম পাশে ৭৫০ মিটার এবং পূর্বপাশে পাঁচ হাজার ১০০ মিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে হবে। এতে কলেজ সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৯ দশমিক ২৬৮৭ কোটি ডলার। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, এলাইনমেন্ট ‘সি’ টানেল নির্মাণ হলে যানবাহন শহরের বাইরে দিয়ে যাবে। ফলে শহরের মধ্যে যানবাহনের চাপ পড়বে না। অন্য দুই স্থানের চেয়ে এলাইনমেন্ট ‘সি’-তে নির্মাণ খরচও অনেক কম হবে।

 

সেতুবিভাগ আরো জানায়, এলাইনমেন্ট ‘সি’ অর্থাৎ তিন নম্বর অপশনে টানেলটি নদীর উত্তরপাশে সি বিচ নেভাল গেট পয়েন্ট থেকে নদীর ১৫০ ফুট নিচ দিয়ে অপরপাশে গিয়ে উঠবে। দক্ষিণ পাড় থেকে সংযোগ সড়ক দিয়ে বাঁশখালী সড়কে গিয়ে উঠবে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ করা হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমে যাবে প্রায় ৩০ কিলোমিটার।

 

গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের লক্ষ্যে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক সই হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর চীন সরকারের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ২৬ সদস্যের চীনা প্রতিনিধি দল কর্ণফুলীর মোহনার উভয় তীর পরিদর্শন করেন।

সূত্র:রাইজিংবিডি