সেনা সরকারের কবজায় মিয়ানমার এখন কেমন

সেনা অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। মিয়ানমার এখন সেনা সরকারের পুরো কবজায়। দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় অবশ্য খুব বেশি পরিবর্তন চোখে পড়ে না। পার্থক্য বলতে রাস্তায় রয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী।

গতকাল সোমবারের সেনা অভ্যুত্থানের পর আজ মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত মিয়ানমারে বড় ধরনের কোনো বিক্ষোভ হয়নি। সকালে এক ট্যাক্সিচালক এএফপিকে বলেন, ‘আমরা বিক্ষোভ করতে চাই। কিন্তু আমাদের মা (সু চি) তাঁদের হাতে। আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারি না।’

ইয়াঙ্গুনে মিয়ানমারের সরকারি টিভি কেন্দ্রের ভেতরে সাঁজোয়া যান।

ভোরের আলো ফোটার আগেই গতকাল সু চি ও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে নেপিডো থেকে আটক করে সেনাবাহিনী। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে সু চির দল এনএলডির মুখপাত্র মিয়ো নিয়ুন্ত এএফপিকে এ কথা জানান। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নেপিডোর সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়। নেপিডোয় সশস্ত্র সেনাবাহিনীর টহল চলতে থাকে। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার শহরজুড়ে নজরদারি করতে থাকে।

মিয়ানমারে গতকাল প্রায় সারা দিন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। ব্যাংকগুলোও বন্ধ ছিল। মিয়ানমার ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, আজ ব্যাংক খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো বন্ধ রয়েছে শেয়ারবাজারের কার্যক্রম।

গতকাল রাতের দিকে মিয়ানমারের সরকারি টিভিতে এক ঘোষণায় সু চি সরকারের ২৪ মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। নতুন ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

সু চির এনএলডি পার্টির এক পার্লামেন্ট সদস্য (সেনাবাহিনীর ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এএফপিকে বলেন, ‘পার্লামেন্ট সদস্যরা আবাসিক ভবনে স্বাভাবিকভাবেই জীবন কাটাচ্ছেন। তবে আবাসিক ভবনের জীবন এখন উন্মুক্ত জায়গায় অবস্থিত বন্দিশিবিরের মতো। আমাদের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।’
এনএলডির এক আইনপ্রণেতা এএফপিকে জানান, সু চি ও উইন মিন্ট এখন গৃহবন্দী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আইনপ্রণেতা বলেন, ‘আমাদের চিন্তা না করতে বলা হয়েছে। তবে আমরা চিন্তা না করে পারছি না। যদি আমরা বাড়িতে থাকা অবস্থায় তাঁদের ছবি দেখতে পারতাম, তাহলে চিন্তামুক্ত হতাম।’

সেনা অভ্যুত্থানে যা ঘটেছে

গতকাল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দলের নেত্রী অং সান সু চি, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ও বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাকে আটক করে। পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গতকাল। সেদিনই এ ঘটনা ঘটে।

সাবেক জেনারেল মিন্ট সোয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হলেও মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের হাতেই এখন দেশের ক্ষমতা। সেনাবাহিনী গতকাল মিয়ানমারে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। সেনাবাহিনী বলেছে, এরপর তারা নির্বাচন দেবে।

আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্র আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে বলে হুমকিও দিয়েছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়া সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাজ্য মিয়ানমারের দূতকে তলব করেছে। তবে চীন কোনো পক্ষের সমালোচনা না করে বিভেদ মেটানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে।

মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আজ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠক ডেকেছে।

পিছু ফিরে দেখা

২০১১ সালে ৪৯ বছরের সেনাশাসন থেকে মুক্ত হয় মিয়ানমার। গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারে দ্বিতীয় দফা গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এনএলডি এতে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাদের দাবি, তাদের কাছে এক কোটিরও বেশি কারচুপির ঘটনার প্রমাণ রয়েছে। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল আগে থেকেই। সু চি তাই অভ্যুত্থানের আগেই চিঠি লিখে রেখেছেন। আটকের আগে সু চির লেখা একটি চিঠি তাঁর দলের চেয়ারপারসন ফেসবুকে পোস্ট করেন। তাতে অভ্যুত্থান মেনে না নিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী সু চি মিয়ানমারে বেশ জনপ্রিয়। তবে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের প্রতিবাদ না করায় আন্তর্জাতিক মহলে তিনি সমালোচিত হন।

সেনা অভিযানে নির্যাতনের কারণে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘের তদন্তকারী দল সেনা অভিযানে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে।

গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে আহ্বান

সামরিক শাসনের পর মিয়ানমারে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রদূত ডেরেক মিচেল বলেন, নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সু চিকে শ্রদ্ধা করা উচিত। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে সু চিকে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে মেনে শ্রদ্ধা করতে হবে। তিনি বলেন, এটা ব্যক্তির বিষয় নয়; প্রক্রিয়ার বিষয়।

 

সুত্রঃ প্রথম আলো