সুস্থ-সবল হয়ে বেড়ে উঠুক আগামী প্রজন্ম

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন পত্রিকার খবরমতে, বাংলাদেশে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের উচ্চতা অন্যান্য দেশের মেয়েদের তুলনায় ২০ সেন্টিমিটার বা ৭ ইঞ্চি কম। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা ‘অ্যাস্ট্রোজেনেকা’ নামীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী বহুজাতিক একটি সংস্থার সহযোগিতায় ১৯৩টি দেশের ৬৫ মিলিয়ন ব্যক্তির ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ‘দ্য লেনসেট’-এ প্রকাশিত হয়।

এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের গড় উচ্চতা যতটুকু, নেদারল্যান্ডসের ১১ বছর বয়সীদের উচ্চতা ততটুকু। গবেষকরা বলছেন, শিশুকালে পুষ্টিকর খাবারের অভাব শারীরিক উচ্চতার ভিন্নতা তৈরি করছে। গুণগত মানসম্পন্ন খাবার না খাওয়ার কারণে উচ্চতা হারাচ্ছে দেশের কিশোরীরা। আর এমনটি ঘটছে ব্যক্তি ও পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য, খাদ্যাভ্যাস ও যথাযথ পুষ্টিজ্ঞানের অভাবের কারণে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি রিপোর্ট মতে, গত শতকের শেষের দিকে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির জন্য বাংলাদেশে ৫৬ শতাংশ শিশুর ওজন বয়সের অনুপাতে কম ছিল। আমাদের দেশে একই বয়সের ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ও গ্রামের শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে বেশি।

শরীর ঠিক রাখার জন্য মানুষকে সুষম খাবার গ্রহণ করতে হয়। ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে এসেছি আমিষ, শ্বেতসার, স্নেহ পদার্থ, খনিজ লবণ, খাদ্যপ্রাণ ও পানি-এই উপাদানগুলো আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকলে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা হল বলে মনে করা হয়।

আমাদের খাদ্যতালিকায় কি এ উপাদানগুলো থাকে? হয়তো কারও কারও থাকে; কিন্তু অধিকাংশের থাকে না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ-স্বাভাবিক ব্যক্তির জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন ২১০০ থেকে ২২০০ ক্যালরি শক্তিসম্পন্ন খাবার গ্রহণের প্রয়োজন হয়। অনেকেই হয়তো এর থেকে বেশি ক্যালরি ইনটেকও করছেন; কিন্তু সুষম খাদ্য না হওয়ার কারণে পুষ্টি ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এ ব্যাপারে FAO-এর জনৈক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, পেটপুরে শর্করা খেলেও সেখানে যদি অন্যান্য পুষ্টি উপাদান না থাকে, তাহলে সেটাও পুষ্টিহীনতা।

খাদ্যতালিকায় প্রাণিজ খাবার, দুধ, শাকসবজি, ফলমূল পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকায় যথাযথভাবে পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় না। আর পুষ্টিহীনতায় যে কোনো রোগ খুব সহজেই শরীরে ভর করে। রক্তশূন্যতা, চুল পড়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, অল্পতেই ক্লান্তি, দাঁতের মাড়ি ও দাঁত দুর্বল হয়ে যায়।

উঠতি বয়সের মেয়েদের এ সমস্যাগুলোয় ভোগা স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এমনিতে তো তাদের পুষ্টি চাহিদা ঠিকভাবে পূরণ হয় না, তার ওপর আবার কেউ কেউ খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়ে ‘জিরো ফিগার’-এর দিকে ঝুঁকছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে শরীর মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বাড়তি মেদহীন শরীর সব মানুষের জন্যই অত্যন্ত জরুরি; কিন্তু তাই বলে কায়িক পরিশ্রমের বদলে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে অপুষ্টির শিকার ক্ষীণকায় শরীর কখনও কাম্য হতে পারে না। জাপানসহ মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর দেশগুলোর জনগণ গড় উচ্চতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক এক্সারসাইজ করে থাকে। খাবার গ্রহণ না কমিয়ে আমাদের তরুণদেরও এ ধরনের পদ্ধতি অবলম্বনের চেষ্টা করতে হবে।

সুইজারল্যান্ডের নেসলে রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গোটা দিনের মধ্যে দুপুরের খাবার শিশুদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুপুরের খাবার না খেলে শিশুরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। আর আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের দুপুরের খাবারটি অত্যন্ত দায়সারাভাবে সম্পন্ন করে। একটি শিঙাড়া বা একটি স্যান্ডুইচ বা ফাস্টফুডের একটি আইটেম ও এক বোতল কোক দিয়ে ওরা সারাটা দিন পার করে দেয়।

আমাদের সময় স্কুল-কলেজের ছেলেরা দুপুরে বাসায় এসে খাবার খেয়ে যেত, আবার কেউ কেউ টিফিন নিয়ে আসত। সে সংস্কৃতি আজ নির্বাসিত। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের দুপুরের আহারটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এখনকার ছেলেমেয়েরা বাসার খাবার অপেক্ষা বাইরের খাবার বেশি পছন্দ করছে। ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড গোগ্রাসে গিলছে। মা-বাবারাও আগ্রহ ভরে কিনে দিচ্ছে। কিন্তু এ খাবারগুলোর সবই কি মানসম্মত?

একটু দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে, আমাদের নগরীগুলোর সড়ক ও অলিগলিতে বিক্রি হওয়া খাবারগুলো ঢেকে রাখার বালাই নেই বললেই চলে; সারাক্ষণ ধুলাবালি পড়ছে। একই তেল দিয়ে দিনের পর দিন খাবার তৈরি করা হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁ, বেকারি ও বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের দোকানে পা দিয়ে আটা ময়েন করা, মশা-মাছি, তেলাপোকা ভরা টয়লেটের পাশে অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে অপরিষ্কার শরীরে খাদ্যদ্রব্য তৈরির চিত্র ও ভিডিও মনকে বিষাদময় করে তোলে।

ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির এক পরীক্ষায় ঢাকা শহরের ৮৫-৯০ শতাংশ ভেলপুরি, ফুচকা, ঝালমুড়িতে কলেরার জীবাণু ই-কোলাইয়ের উপস্থিতি এবং ভেলপুরি ও ঝালমুড়ির নমুনায় টাইফয়েডের জীবাণু স্যালমোনেলা পাওয়া গেছে। অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁয়; এমনকি বাসাবাড়িতেও থালাবাসন হাঁড়ি-পাতিল একই পানিতে বারবার ধোয়ায় ঠিকভাবে পরিষ্কার হয় না। ফলে রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।

এগুলো যারা খাচ্ছে, তাদের স্বাভাবিক ‘গ্রোথ’ তো দূরের কথা, সারাক্ষণ অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে, শারীরিক ‘সুস্থতা’ ধরে রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আর তাই তো অল্প বয়সে গ্যাস্ট্রিক, ব্লাড প্রেসার ও ডায়াবেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের অনেকেরই মনে একটি ধারণা বদ্ধমূল রয়েছে-দামি খাবার, দামি হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার মানেই বিশুদ্ধ, পুষ্টিকর ও নির্ভেজাল। বর্তমানে এটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এখানেও স্ট্রিটফুডের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার স্টাডি অনুযায়ী বিশ্বে প্রতিদিন ২৫০ কোটি মানুষ স্ট্রিটফুড খেয়ে থাকে। স্ট্রিটফুডের স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা করে ছাড়পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর সব থেকে ভালো হয়, ফাস্টফুড-জাঙ্কফুডের নেশা থেকে তরুণসমাজকে বের করে আনতে পারলে।

২০১৫ সালে সরকার কর্তৃক প্রণীত জাতীয় পুষ্টি নীতিতে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক বৃদ্ধি যেন যথাযথ হয় এবং তারা কাঙ্ক্ষিত উচ্চতা ও ওজনসহ পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে বিকাশ লাভ করতে পারে, সে জন্য তাদের পর্যাপ্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুষ্টি শিক্ষাকার্যক্রম শক্তিশালীকরণ এবং হাসপাতালে ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি কার্যক্রমে মাঠপর্যায়ে পুষ্টিবিদ নিয়োগের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ ও নীতি বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে শামিল হতে হবে।

পুষ্টিকর খাবারে তরুণদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য পারিবারিক পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহযোগিতায় তাদের সচেতন করতে হবে।

অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণ প্রসূতি এবং নবজাতক উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এতে দু’জনেই পুষ্টিহীনতায় ভোগে, বেড়ে ওঠে রুগ্ন শিশু। তাই বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে। নারী শিক্ষার হার ও তাদের কর্মে নিয়োগের সুযোগ বাড়াতে হবে। তাদের আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে পারলে তারা শুধু নিজের নয়, পুরো পরিবারেরই পুষ্টি সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে পারবে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এক কাপ পরিমাণ ভাত ও শাকসবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস দিয়ে খাবারের প্লেট সাজানো হয়। আর আমাদের দেশে পুরো প্লেটজুড়ে থাকে ভাত। আমাদের খাদ্য তালিকায় ফলমূল, দুধ ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাদ্যের সমাহার ঘটাতে হবে।

বিদেশে খাবার টেবিলে সালাদ আইটেম অপরিহার্য, যা আমাদের দেশে নেই। শাকসবজি, বিভিন্ন ধরনের পাতা, ফলমূল, কাণ্ড যেগুলো কাঁচা খাওয়া যায়, সেগুলো কাঁচাই খেতে হবে। অশস্য জাতীয় খাদ্য-দ্রব্য ‘খাবার’ হিসেবে জনপ্রিয় করার মাধ্যমে শর্করা গ্রহণের পরিমাণ কমাতে হবে।

অশস্য জাতীয় খাবারের চাষ ও ফলন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে এবং এসব খাদ্য স্বল্পমূল্যে ও সহজে জনগণের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে না পারলে পুষ্টি সমস্যার সমাধান বিলম্বিত হবে।

যান্ত্রিক জীবনে ভবিষ্যতে প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবারের গুরুত্ব বাড়বে। তাই খাদ্যদ্রব্যে প্রিজারভেটিভ ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। মানসম্মত ও সহনীয় মাত্রায় প্রিজারভেটিভ ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে; নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণ বন্ধ করতে হবে। ভেজাল খাদ্যবিরোধী প্রচারণা, কার্যক্রম ও অভিযান আরও জোরদার করতে হবে।

শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-সবল, অদম্য কর্মস্পৃহাসম্পন্ন তরুণ প্রজন্মই আমাদের আগামী দিনের কাণ্ডারি। জাতীয় পুষ্টিনীতি-২০১৫-তে বলা হয়েছে, অপুষ্টি সমস্যা; বিশেষত জন্মকালীন কম ওজন ও খর্বতা শুধু পুষ্টিকেন্দ্রিক কার্যক্রম দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

এতে খাদ্য নিরাপত্তা, নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন, কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, পরিচ্ছন্নতা বৃদ্ধি ও স্যানিটেশন, পুষ্টিবান্ধব চাষাবাদ ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির বিস্তার ঘটাতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারের একার নয়।

তাই জাতীয় পুষ্টি নীতিতে বর্ণিত দায়িত্বগুলোকে এগিয়ে নিতে সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তা ও সুধীমহলসহ সমাজের সর্বস্তরের ব্যক্তিদের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী

snagari2012@gmail.com