সুলতান মনসুর-মোকাব্বিরে ‘বিব্রত’ ড. কামাল

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধি শপথ নেয়নি। ভোট ডাকাতির অভিযোগে ফল প্রত্যাখ্যান করা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্তে অনড়।

তবে ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরামের দুই নির্বাচিত প্রতিনিধি শপথ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা হলেন- জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খান।

ঢাকসুর সাবেক ভিপি ও আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা সুলতান মনসুর মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। আর সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন গণফোরামের মোকাব্বির খান।

সুলতান মনসুর ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করেছেন। আর সিলেট-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাওয়ায় গণফোরাম নেতা মোকাব্বির ঐক্যফ্রন্টের সমর্থন নিয়ে উদীয়মান সূর্য প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন।

সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান শপথ নেয়ার কথা বললেও গণফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শপথের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত বলবৎ আছে, তথা গণফোরামের কোনো প্রতিনিধি শপথ নেবে না।

গণফোরাম থেকে এ ধরনের বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও শপথের বিষয়ে অনড় সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির। দল শপথের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিলেও তিনি শপথ নেবেন এমন জোরালো অবস্থানে তারা।

এমতাবস্থায় এ দুই নেতার ভূমিকায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে গণফোরাম। ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল বিশেষ করে বিএনপি গণফোরামকে এ নিয়ে দুষছে। চাপে রেখেছে অন্য দলগুলোও। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এক ধরনের জোট নেতাদের চাপে আছেন।

অসুস্থতার কারণে গত কয়েক দিন দেশের বাইরে ছিলেন ড. কামাল হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার তিনি দেশে ফিরেছেন। এমতাবস্থায় আজ এ দুই নেতাকে নিয়ে বসবেন তিনি; পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করবেন। তাদের শপথগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কথা বলবেন।

৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট শেষ হওয়ার পর ওই রাতেই বিএনপি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানায়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য দলগুলোও নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে। বিএনপির পক্ষ থেকে পরে জানানো হয়, তাদের নির্বাচিতরা কেউ শপথ নেবেন না।

কিন্তু গণফোরাম বিএনপির এমন সিদ্ধান্তে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও গোপনে তারা ভিন্ন মনোভাব দেখায়। ৫ জানুয়ারি রাজধানীর শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে গণফোরামের বর্ধিত সভা শেষে শপথের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট আলোচনার মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।

আমার ধারণা, সংসদে যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছি ঠিকই; কিন্তু আমাদের প্রার্থীরা বিরোধী দল থেকে জয়লাভ করেছেন। পরের দিন গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, ড. কামাল হোসেনের একটি বক্তব্য নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।

ড. কামাল হোসেন কোনোভাবেই বলেননি যে, গণফোরাম থেকে নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন। এছাড়া ঐক্যফ্রন্টে কোনো ‘অনৈক্য’ নেই।

জানা গেছে, নির্ধারিত নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্য (এমপি) হিসেবে শপথ নিতে চান গণফোরামের দুই এমপি। এ প্রসঙ্গে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, আমরা কখনও বলিনি শপথ নেব না। ড. কামাল হোসেনও বলেছেন, শপথ নেয়ার ব্যাপারে আমরা ইতিবাচক। আর এটাই আমাদের কথা।

এর বাইরে অন্যরা কে কী বলেছে, তা আমি জানি না। সময় তো আছে, তাড়াহুড়ার কিছু নেই। ৯০ দিনের মধ্যে শপথ নিলেই হবে। তিনি বলেন, জনগণ শত প্রতিকূলতায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের নির্বাচিত করেছে। আমি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছি। তবে সরাসরি বিএনপি থেকে নির্বাচন করিনি।

ধানের শীষ ঐক্যফ্রন্টের প্রতীক। যেহেতু নির্বাচন করব, তাই এই প্রতীক নিয়েছিলাম। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে আমাকে কেউ বের করে দেয়নি। আর আমি কোনো দলে যোগদানও করিনি। আমি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। গণফোরাম থেকে নির্বাচনে গেছি। কারণ গণফোরামে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মিল আছে।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি আমাকে ডাকে তাহলে চিন্তা করতে পারি। কারণ আমাকে তো আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলেন, বিএনপি তাদের সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে তো সবাই আলাদা দল। আমাদের সিদ্ধান্ত ‘অবশ্যই পজিটিভ’ হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে মনসুর বলেন, ঐক্যফ্রন্ট সিদ্ধান্ত নিলেও সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের স্বাধীন চিন্তার অধিকার আছে। আমার এলাকার ভোটারদের কথা ভাবতে হবে। তারা কেন আমাকে নির্বাচিত করেছে। ধানের শীষ প্রতীকে আপনি নির্বাচিত হয়েছেন, বিএনপির সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নিলে আইনি কোনো সমস্যা হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, এটা কোনো সমস্যা হবে না।

বিএনপি যদি সংসদে যেত, আর আমি যদি তাদের বিরুদ্ধে সংসদে ভোট দিতাম, সেক্ষেত্রে সমস্যা হতো। এখন যেহেতু বিএনপি সংসদে যাচ্ছে না। তাই আমার শপথে কোনো সমস্যা হবে না। আমি তো গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছি। আমার এলাকার জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে সংসদে কথা বলার জন্য। তাদের জন্য কাজ করতেই আমাকে সংসদে যেতে হবে।

সিলেট-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনার প্রার্থিতা হাইকোর্ট বাতিল করলে গণফোরামের প্রার্থী মোকাব্বির খানকে ‘উদীয়মান সূর্য’ প্রতীকে সমর্থন দেয় বিএনপি। মোকাব্বির খান বলেন, শপথ গ্রহণের বিষয়ে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। ফোরামের সিদ্ধান্তও ইতিবাচকই হবে বলে আশা করি। আমরা গণফোরাম ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। তবে বিএনপি কী করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। বিএনপির সিদ্ধান্ত তাদের নিজস্ব।

তবে তাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সংসদের ফ্রন্টের কোনো সংসদ সদস্য শপথ নেবে না এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।

শুধু ফ্রন্ট নয়, দল হিসেবে গণফোরামও শপথ নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তারা যদি শপথ নেয়, তাহলে সেটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। তিনি বলেন, এরা দু’জনই গণফোরাম থেকে নির্বাচিত। দু’জনই গণফোরামের নেতা।

ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, শপথ না নেয়ার ব্যাপারে ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত এখনও বহাল আছে। ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে হলেও তারা দু’জন গণফোরাম থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। শপথ নেয়া বা না নেয়ার ব্যাপারে তাদের দল সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তা অবশ্যই ঐক্যফ্রন্টকে জানানোর কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তেমন কিছু জানিনি।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে এখনও অটল আছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। প্রহসনের এই নির্বাচনে সংসদে যাওয়ার কোনো মানে নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরামের নির্বাচিত দুই সংসদ সদস্য (এমপি) শপথ নেবেন কি না- জানতে চাইলে রিজভী বলেন, এ বিষয়ে কিছু জানি না। আমি যতটুকু জানি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যেখানে বিএনপিসহ অন্যান্য সবাই আছেন, সবাই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে। যা করা হবে, সবার একই সিদ্ধান্ত হবে।

এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দুই দফা বৈঠকে এবং ঐক্যফ্রন্টের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কেউ শপথ নেবেন না। অপরদিকে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেন, শপথ নিয়ে আপনারা বেঈমানি করবেন না।

এই সরকার যে নির্বাচন করেছে, সেটাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। বিএনপির যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করবে না, বেঈমানি করবে না, সংসদে যাবেন না। সংসদে যদি যায়, আমরা মনে করব, তারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

এমতাবস্থায় আজ বুধবার বিকালে গণফোরামের কাউন্সিল প্রস্তুতি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে মতিঝিলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। ওই বৈঠকেই সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খানকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন।

এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, তিনি সুলতান মনসুর ও মোকাব্বিরকে পরিস্থিতি বোঝাবেন। তার আশা, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না এ দুই নেতা। এ বিষয়ে আজ বিকালে তিনি বিস্তারিত জানাবেন।

বুধবার সকালের দিকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খানের ড. কামালের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে। দেখা করার সময়েই মূলত তিনি জানতে চাইবেন— কেন তারা সংসদে যেতে চাইছেন?