সুদ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে নিঃস্ব দুর্গাপুরের শতাধিক পরিবার


নিজস্ব প্রতিবেদক: সুদ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন রাজশাহীর দুর্গাপুরের শতাধিক পরিবার। মাসিক ১০ ভাগ টাকা সুদ প্রদানের কথা বলে নেওয়া টাকার বিপরীতে ২০০-৩০০ গুন টাকা প্রদান করেও শোধ হচ্ছে না আসল টাকা। উপরুন্ত টাকা প্রদানের সময় প্রত্যেকের নিকট থেকে নেওয়া ফাঁকা চেকের বিপরীতে মামলা মোকদ্দমা করে একের পর এক হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি মামলা টানতে গিয়েও অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিরমুখে পড়েছেন ভূক্তভোগী পরিবারগুলো। সুদখোরদের চাহিদামতো টাকা দিতে না পারায় এবং মামলা-মোকদ্দমা বা নানাভাবে হুমকি-ধামকির কারণে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে পলাতক জীবন-যাপন করতেও বাধ্য হচ্ছেন। এসবের প্রতিকার চেয়ে ভূক্তভোগীদের মধ্যে চারজন গতকাল রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের কপি দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরেও। এতে সুদ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন।

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তারা হলেন, পুঠিয়া উপজেলার মহেন্দ্রা গ্রামের মৃত এশারুদ্দিনের ছেলে ইয়াকুব আলী ও মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে মনি স্বর্ণকার, দুর্গাপুর উপজেলার ঝালুকা গ্রামের মৃত আইয়ুব আলীল ছেলে সোহেল রানা এবং ওয়াহেদ আলী।

এলাকাবাসী সূত্র মতে, এই সুদ ব্যবসায়ীরা একসময় দিনমজুর ছিলেন। কিন্তু সুদের কারবার করে এখন তারা লাখ লাখ টাকার মালিক। কেউ কোটিপতি বনেও গেছেন। তারা একেকজন গড়ে তুলেছেন পাকা আলিশান বাড়ি-গাড়ি। অন্যদিকে সুদের বোঝা বইতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন দুর্গাপুরের আমগাছী, ঝালুকা, গৌরিহার, হাড়িয়াপাড়া, আন্দুয়া, বর্দ্ধনপুর, চৌপুখরিয়াসহ আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের শতাধিক পরিবার। সূদের টাকা দিতে না পারায় কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আ মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে দাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুদখোররা।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর দুর্গাপুরের গৌরিহার গ্রামের আবুল কালাম প্রায় তিন বছর আগে পার্শবর্তী পুঠিয়া উপজেলার মহেন্দ্রা গ্রামের ইয়াকুব আলীর নিকট থেকে এক লাখ টাকা মাসিক ১০ ভাগ হারে সুদ প্রদানের শর্তে ধার নেন। ওই সময় কালামের নিকট থেকে একটি ফাঁকা চেক জামানত হিসেবে নেন ইয়াকুব আলী। এরপর সেই এক লাখ টাকার বিপরীতে তিনি দুই বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রদান করেন। কিন্তু এক বছর ধরে আর্থিক টানা-পোড়েনের কারণে আর সুদের টাকা দিতে পারেননি আবুল কালাম। এতে করে ইয়াকুব কালামের নামে ফাঁকা চেকের বিপরীতে মামলা করাসহ নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কখনো কখনো দলবল নিয়ে বাড়িতে গিয়েও হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছেন। এতে করে অনেক সময় বাড়িতেও থাকতে পারছেন না আবুল কালাম। এমনকি স্ত্রী-সন্তানও নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সুদখোর ইয়াকুবের দাপটে। অন্যদিকে আর্থিক টানা-পড়োনের কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকটা অসহায় দিনাতিপাত করছেন কালামের পরিবারের সদস্যরা।

একইভাবে কালাম সুদ ব্যবসায়ী মনি র্স্বনকারের নিকট থেকে দুই বছর আগে একটি ফাঁকা চেক দিয়ে মাত্র ৮০ হাজার টাকা ধার নেন। ওই টাকার বিপরীতে তিনি এক লাক ২০ টাকা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু তাতেও মূল টাকাসহ আরও প্রায় এক লাখ টাকা দাবি করে আসছে মনি। ওই টাকা না দিলে চেকের বিপরীতে মামলা দেওয়াসহ নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে কালামকে।

এদিকে দুর্গাপুরের আমগাছী গ্রামের শফিকুল ইসলাম ইয়াকুবের নিকট থেকে ব্যবসায়ীক কাজে ফাঁকা চেক দিয়ে ৬ লাখ টাকা ধার নেন। সেই টাকার বিপরীতে ইয়াকুবকে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন শফিকুল ইসলাম। শফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ওই ৬ লাখ টাকার বিপরীতে ফাঁকা চেকে ২০ লাখ টাকার অংক বসিয়ে শফিকুলকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন ইয়াকুব আলী। এমনকি বাড়িতে গিয়েও ইয়াকুব ও কার সাঙ্গ-পাঙ্গরা নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছে। এতে করে তিনি চরম বিপাকে পড়েছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সুদ কারবারি ইয়াকুব এভাবে দুর্গাপুর ও পুঠিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তিতে মাসিক সুদ হারে টাকা ধার দিয়ে কোটিপতি বনে গেছেন। ফাঁকা চেক নিয়ে পরবর্তিতে টাকা গ্রহণকারীদের নিকট থেকে ২০০-৩০০ গুনের বেশি টাকা আদায় করে চলেছেন। টাকার জন্য অন্তত ২২ জনের আদালতে মামলাও করেছেন এই সুদখোর ইয়াকুব আলী।

তবে ইয়াকুব দাবি করেন, সুদের টাকা পরিশোধ না করায় তিনি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। কারো কারো নামে মামলা করেছেন। তবে কাউকে হুমকি বা হয়রানি করা হয়নি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টাকার উৎস হলো ব্যবসা। আমি ব্যবসা করে টাকা আয় করেছি। সেই টাকা ধার দেয় মানুষকে।’

অপরদিকে দুর্গাপুরের হাড়িয়াপাড়া গ্রামের জুয়েল রানা অভিযোগ করেন, তিনি ঝালুকা গ্রামের ওয়াহেদ আলীর নিকট থেকে তিন বছর আগে ৫০ হাজার টাকা ও সোহেল রানার নিকট থেকে ১৪ হাজার টাকা মাসিক ১০ ভাগ হারে সুদ দেওয়ার শর্তে ধার নেন। ওই টাকার বিপরীতে ওয়াহেদকে এক লাখ ২০ টাকা এভং সোহেল রানাকে ৩০ টাকা দিয়েছেন জুয়েল রানা। কিন্তু ওয়াহেদ ফাঁকা চেকের বিপরীতে জুয়েল রানার নামে ৮ লাখ টাকার মামলা দিয়েছেন। আর সোহেল রানা ফাঁকা চেকের বিপরীতে জুয়েলের বিরুদ্ধে ৬ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বলে মামলা করেছেন। এই মামলা দুটি চালাতে গিয়েও আর্থিকভাবে ক্ষতিরমুখে পড়েছেন জুয়েল। এমনকি দেনার দায়ে তিনি এখন বাড়ি ছেড়ে পলাতক জীবন-যাপন করছেন। সোহেল এবং ওয়াহেদ দুই ভাই সুদ ব্যবসায়ী বলে স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোজাহার আলী এককটি প্রত্যায়নপত্রও দিয়েছেন।

তবে সোহেল রানা এবং ওয়াহেদ দাবি করেন, তাদের নিকট থেকে জুয়েল রানা টাকা ধার নিয়ে আর দেয়নি। তাই তারা জুয়েল রানার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

এসব নিয়ে জানতে চাইলে র‌্যাব-৫ রাজশাহীর অধিনায়ক ল্যাফটেন্যান্ট কর্ণেল আব্দুল মোত্তাকিন বলেন, সুদের টাকা নিয়ে অনেক পরিবার হয়রানির শিকার হচ্ছে। এমন অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। কিন্তু জনবল না থাকায় আমরা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারছি না।’

অন্যদিকে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, এই ধরনের অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। তবে মানুষের সচেতনতার অভাবের কারণে তারা নিজেরাই বিপদ ডেকে নিয়ে আসছে। তার পরেও হয়রানির শিকার ব্যক্তিরা অভিযোগ করলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিব।

স/জে