সিরাজগঞ্জ কাউন্সিলর হত্যাঃ স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ স্ত্রী দিশেহারা সন্তান

নির্বাচন শেষ। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা। ওয়ার্ডজুড়ে বইছে আনন্দের সুভাষ। বিজয়ী কাউন্সিলর তরিকুল ইসলাম খানের গলায় মালা পরানোর প্রস্তুতি চলছে। স্ত্রী আর দুই সন্তান তখন গভীর প্রার্থনায় মগ্ন। ঠিক এমনই সময় ছড়িয়ে পড়ে তরিকুলকে হত্যার খবর। মুহূর্তেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে স্বজন ও সমর্থকদের ওপর।

প্রিয় স্বামীকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন স্ত্রী হাসি খাতুন। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন ছেলে একরামুল হাসান হৃদয় ও মেয়ে তাহিদা জাহান তিজা।

এদিকে এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্থানীয়রা। এ হত্যার ঘটনায় রোববার দুপুরে নিহত তরিকুলের ছেলে একরামুল হাসান হৃদয় বাদী হয়ে পরাজিত কাউন্সিলর প্রার্থী সাহেদনগর ব্যাপারীপাড়া মহল্লার বাসিন্দা ও ৬নং ওয়ার্ড আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন বুদ্দিনকে প্রধান আসামি করে ৩২ জনের নাম উল্লেখসহ ৪০-৫০ জনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দাখিল করেছেন।

তরিকুলের স্বজন-সমর্থক ও স্থানীয়রা জানান, শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে সিরাজগঞ্জ পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের শহীদগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বুদ্দিন তার সমর্থকদের নিয়ে ভোটের ফল প্রকাশে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে- এমন খবরে তরিকুল সেখানে যান। পরে বেসরকারি ফলে ৮৪ ভোটে নির্বাচিত হন ডালিম প্রতীকের প্রার্থী তরিকুল।

সদর থানার ডিউটি অফিসার এসআই শাহিন বলেন, অভিযোগটি পেয়েছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ সময় আগে থেকে অবস্থান নেওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বুদ্দিন নিজের পরাজয় সইতে না পেরে তৎক্ষণাত ধারালো অস্ত্র দিয়ে তরিকুলের পেটে আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যায়।

সেখানে অবস্থার অবনতি হলে সিরাজগঞ্জ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা সাহেদনগর ব্যাপারীপাড়া এলাকায় একটি বাড়ি, দুটি ট্রাক, একটি প্রাইভেট কার ও পাঁচটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। এ সময় আরও তিনটি বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

তরিকুল হত্যার প্রতিবাদে রোববারও প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ মিছিল করেন এলাকাবাসী। সকালে নিহত তরিকুলের নতুন ভাঙ্গাবাড়ি মহল্লার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তরিকুলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও অভিযুক্ত ৬নং ওয়ার্ড আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন বুদ্দিনসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে মিছিল করছে এলাকার হাজারও নারী-পুরুষ।

এ সময় কথা হয় নতুন ভাঙ্গাবাড়ি মহল্লার বাসিন্দা ও জেলা আ.লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন জুয়েলের সঙ্গে। তিনি জানান, নিহত তরিকুল গ্রাম পঞ্চায়েতের সাধারণ সম্পাদক, মাদ্রাসা-মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক, ঈদগাহ মাঠের সাধারণ সম্পাদক এবং রহমতগঞ্জ কবরস্থান কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

তাছাড়া তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীও ছিলেন। সম্প্রতি পৌর আ.লীগ নেতার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আ.লীগে যোগদান করেন তিনি। এর আগে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার বাবা সাবেক পৌর কমিশনার মরহুম আব্দুল কুদ্দুস খান ছিলেন ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। নম্র, ভদ্র ও সততার কারণে এলাকায় তরিকুল ছিলেন বেশ জনপ্রিয়।

যে কারণে এবারের নির্বাচনে নতুন ভাঙ্গাবাড়ি থেকে আরও দুজন কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিলেও পঞ্চায়েত কমিটি বসে তাকে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে। তার এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

বর্তমান কাউন্সিলর শাহাদৎ হোসেন বলেন, তরিকুলের মতো ভালো ছেলে সচরাচর পাওয়া যায় না। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি গরিব-দুঃখী মানুষের আপদে-বিপদে পাশে থাকতেন। তাকে হারিয়ে আমরা বাকরুদ্ধ।

সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম (বিপিএম) বলেন, রোববার সকালে ঘটনাস্থল শহীদগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি টিএম মোজাহিদুল ইসলাম। এর আগে নিহতের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিয়ে সমবেদনা জানান তিনি।

তার নির্দেশে দুজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ডিবির ওসির সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে এ তদন্ত টিম চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে। অতিদ্রুতই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে রোববার বাদ জোহর নতুন ভাঙ্গাবাড়ি মসজিদ মাঠে কয়েক হাজার মুসল্লির অংশগ্রহণে নিহত তরিকুলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ, পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম, পৌর মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা, জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ তালুকদার, পৌর আ.লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রমুখ।

এ সময় পৌর আ.লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ৬নং ওয়ার্ড আ.লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে শাহাদৎ হোসেন বুদ্দিনকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন।

গাইবান্ধায় গাড়ি ভাঙচুরে দুই মামলা, ৫ গ্রেফতার : গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, এ পৌরসভার পূর্ব কোমরনই কুঠিপাড়া এলাকায় ব্যালট গণনা নিয়ে উত্তেজিত জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনায় র‌্যাব ও পুলিশ দুটি মামলা করেছে। এর মধ্যে ৪১ জনের নাম উল্লেখ করে র‌্যাব এবং পুলিশ ৪৭ জনসহ অজ্ঞাতনামা ১৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। এদের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে মামলার পর ভয় ও গ্রেফতার এড়াতে পূর্ব কোমরনই কুঠিপাড়া এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।

 

সুত্রঃ যুগান্তর