সারা বিশ্বেই সংঘাত বন্ধ করতে হবে

শুধু ইউক্রেনই নয়, সারা বিশ্বেই যুদ্ধ-সংঘাত বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী জোডি উইলিয়ামস। আর চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল বিজয়ী রিচার্ড জন রবার্টস বলেছেন, শান্তির জন্য বিশ্বকে পরমাণু অস্ত্র মুক্ত হতে হবে।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : যুদ্ধ কি অনিবার্য? আমরা কি দৃষ্টান্ত বদলাতে পারি?’ শীর্ষক ওয়েবিনারে দুই নোবেল বিজয়ী এ কথা বলেন।

স্থল মাইনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারণায় ভূমিকার জন্য ২০১৭ সালে শান্তিতে নোবেল পান জোডি উইলিয়ামস।

গতকাল ওয়েবিনারে বক্তব্যের শুরুতেই জোডি উইলিয়ামস বলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকেই তিনি যুদ্ধবিরোধী। তিনি একজন যুদ্ধবিরোধী কর্মী।

ইউক্রেনসংকট প্রসঙ্গে জোডি বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব ভুলে গেছে, মিয়ানমারে সংঘাত চলছে। সেখানে জেনোসাইড হয়েছে। কঙ্গো, সুদান—এ ধরনের আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। ইউক্রেনের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য হলো ইউক্রেন ইউরোপে, পশ্চিমা দেশ। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের ব্যাপারে সচেতন হলে সারা বিশ্বের ব্যাপারেই সচেতন হতে হবে। যুদ্ধ ও সহিংসতার শুরু ক্ষমতার জন্য আকাঙ্ক্ষা থেকে। পরিবর্তনের জন্য, যুদ্ধ থামানোর জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা এমন এক বিশ্বে বসবাস করি, যেখানে এখনো পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার কথা চিন্তা করা হয়। মানুষের শান্তিতে বসবাসের সুযোগ প্রয়োজন। এটি মানবাধিকার। ’

জোডি বলেন, পরিবর্তনের জন্য প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু করার আছে। প্রত্যেককে উদ্যোগ নিতে হবে।

ইউক্যারিওটিক ডিএনএর অনুপ্রবেশ এবং জিন-স্প্লিটিংয়ের পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ফিলিপ অ্যালেন শার্পের সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ব্রিটিশ প্রাণরসায়নবিদ ও আণবিক জীববিজ্ঞানী রিচার্ড জন রবার্টস। ওয়েবিনারে তিনি বলেন, ইউক্রেন সংকটের পটভূমিতে যুক্তরাজ্য নতুন করে পরমাণু অস্ত্রের বিষয়ে চিন্তা করছে। নিরস্ত্রকরণ হলেই তা চমৎকার সিদ্ধান্ত হবে।

রবার্টস বলেন, রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে। এটি মোকাবেলায় পশ্চিমারা ব্যর্থ হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘জেলেনস্কি একজন পেশাদার কমেডিয়ান। আমাদের রাজনীতিতে তাঁর মতো আরো পেশাদার কমেডিয়ান দরকার। কারণ তিনি যা করতে পারছেন, রাজনীতিবিদরা তা পারছেন না। ’

ওয়েবিনারে প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন মন্তব্য করেছিলেন, পশ্চিমারা ইউক্রেনের যুদ্ধকে এশিয়া ও আফ্রিকার যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে আলাদা করে দেখছে। জোডি উইলিয়ামস বলেন, ইউক্রেনে হোক বা মিয়ানমার, কঙ্গো বা অন্য যেকোনো স্থানেই হোক, হত্যা হত্যাই। ইউক্রেনের শরণার্থীদের ইউরোপে স্বাগত জানানো হচ্ছে। অথচ ইউক্রেনে অধ্যয়নরত আফ্রিকার কিছু শিক্ষার্থীকে ট্রেনেই উঠতে দেওয়া হয়নি।

এক প্রশ্নের জবাবে রবার্টস বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণরা ইউক্রেন পরিস্থিতির তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে।

জোডি উইলিয়ামস ওয়েবিনারের এক পর্যায়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের মতামত জানতে চান। শাখাওয়াত হোসেন বলেন, নাপাম বোমার  ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে নাপাম বোমা ব্যবহার করেছিল। আফগানিস্তানে বড় শক্তিগুলোর ছয় যুদ্ধ চলেছে। এরপর ২০ বছরের দখলদারি ও হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে। ইরাক তছনছ করা হয়েছে। রাশিয়া কখনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু ইউক্রেনের আজভ ব্যাটালিয়নকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আজভ ব্যাটালিয়ন ইউক্রেনে রুশ ভাষাভাষীদের হত্যা করছিল।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে রাশিয়ার পেটে ‘অলিখিত ন্যাটো সদস্য’ বানিয়েছে। এই যুদ্ধ এরই মধ্যে সাদা-কালোর পার্থক্য করেছে।

সাখাওয়াত হোসেনের প্রশ্ন ছিল, এই যুদ্ধ কি ঠেকানো যেত? জবাবে রিচার্ড জন রবার্টস বলেন, তিনি কূটনীতিতে বিশ্বাস করেন। তবে বিজ্ঞানীদের স্বাধীনতা আছে, কূটনীতিকদের নেই। কারণ কূটনীতিকদের সরকারের নির্দেশনা অনুসারে চলতে হয়। এর পরও কূটনীতি খুব ভালো উদ্যোগ। তবে কূটনীতি সময়ের আগে করতে হবে, সময়ের পরে নয়।

রিচার্ড বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে উসকানিমূলক। ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন স্থানে পশ্চিমাদের অনেক বাজে দৃষ্টান্ত আছে।

ইউক্রেনে পুতিন একা দোষী নন এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইইউরও ভূমিকা আছে—এমন মতামতের জবাবে জোডি উইলিয়ামস বলেন, প্রত্যেককে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। কার কী ভূমিকা তা অন্য কেউ বলে দেবে না। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বৈরাচারী হতে চেয়েছিলেন। তাঁকে বন্দি করা উচিত।

জোডি উইলিয়ামস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিগত বছরগুলোতে কয়টি দেশে সরকার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তক্ষেপ করেছে তা এক অধ্যাপক দেখিয়েছেন। ‘নেটিভ আমেরিকানদের’ বিরুদ্ধে জেনোসাইড যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকার করে না। ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ এখনো পৌরাণিক কথা। কারণ বাস্তবতা ভিন্ন।

আইএসকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করা হলেও ইউক্রেনের আজভ ব্যাটালিয়নকে কেন সন্ত্রাসী বলা হয় না—এই প্রশ্নের জবাবে জোডি উইলিয়ামস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের বিরুদ্ধে কথা বললে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করে। একই অবস্থা রাশিয়ার ক্ষেত্রেও।

জোডি বলেন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী প্রথম আমেরিকান নারীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনেক তদন্ত প্রতিবেদন ছিল। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করা হয়। এগুলো পরোয়া না করার কথা জানিয়ে জোডি বলেন, ‘আমি পরোয়া করলে কূটনীতিক হতাম। ’ এ প্রসঙ্গে রিচার্ড জন রবার্টস বলেন, ক্ষমতাবানরাই ঠিক করে কে সন্ত্রাসী হবে।

ওয়েবিনারে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও অধ্যাপক হেলাল মহিউদ্দিন বক্তব্য দেন। ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ইশরাত জাকিয়া সুলতানা।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ ও দৈনিক প্রথম আলো যৌথভাবে ওয়েবিনার আয়োজন করে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ