সাত‘শ ঘোড়ার গাড়ির মধ্যে সাতটিও নেই এখন!

শফিক আজম:
রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট। এই স্থানটিকে ঘিরে এক সময় বসতো কোচোয়ানদের (ঘোড়ার গাড়ি চালক) মিলনমেলা। জিরো পয়েন্টের আশপাশে সারি সারি করে সাজানো থাকতো সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। তখন দূরবর্তী বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়িই ছিল একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু কালের বিবর্তনে এবং উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিলীন হয়ে গেছে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ এই বাহনটি।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে রাজশাহীতে প্রায় ৭’শ ঘোড়ার গাড়ির ছিল। নগরবাসীর দুরের যাত্রার একমাত্র বাহন ছিল ঐহিত্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীর হরিপুর, কাটাখালি, বানেশ্বর ও নওহাটাসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে গাড়ি নিয়ে জড়ো হতেন কোচোয়ানরা। যাত্রী পরিবহণের পাশাপাশি পণ্য পরিববহণেও এই গাড়ির জুড়ি ছিল না।

 

পুরনো সেসব কোচোয়ানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তখনকার আমলে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বেশি ঘোড়া আনা হতো। কিছু কিছু ঘোড়া বগুড়া থেকে নিয়ে আসা হতো। তখন একটি ঘোড়ার দাম ছিল ২’শ থেকে ৩’শ টাকা। এখন এই ঘোড়ার দাম ২০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহীতে পাক হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবে মানুষসহ নিরীহ পশুপাখিও রেহাই পায়নি। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রেও অনেক কোচোয়ান ঘোড়াসহ নিহত হন। অনেকে প্রাণ ভয়ে রাজশাহী থেকে পালিয়ে যান। তবে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে নিহতের সংখ্যাই বেশি। আবার অনেকে যুদ্ধের পরে নিজ পেশা বদলান। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঘোড়ার কোচোয়ান, গাড়ির সংখ্যা- দুটোই অনেক কমে যায়। আর সংখ্যায় কম হওয়ায় তাদের বিপুল চাহিদারও মাথা নুইয়ে যায়। একটা সময় রাজশাহীর জিরো পয়েন্টের সেই ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া ষ্ট্যান্ডটিও বিলীন হয়ে যায়। প্রায় থেমে যেতে বসে ঘোড়ার বাহন।

 

এই ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজশাহীর সাহেব বাজার এবং রাজশাাহী কলেজ সংলগ্ন মাস্টারপাড়া এলাকায় ছিল বেশ কিছু কোচোয়ানদের ঠিকানা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে এক হিন্দু ব্যাক্তি ঘোড়া চালকদের গাড়ি রাখার জন্য জায়গা করে দেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঘোড়া চালকরা সংখ্যায় কমে গেলে কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ীরা তা নিজেদের দখলে নিয়ে নেন। কাঁচা বাজারের প্রসার বেড়ে গেলে জায়গা সঙ্কটে পড়েন গোড়ার গাড়ির চালকেরা। নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে বসায় পেশা বদলাতে শুরু করেন তারা।

 

রাজশাহীর ঐহিত্যবাহী ঘোড়ার বাহন এখন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে। বতর্মানে রাজশাহীতে ঘোড়াগাড়ির ব্যবহার নামে মাত্র। অতীতে যা ছিলো সংখ্যায় ৭’শ তা এখন মাত্র ৫! এই পেশাকে শুরু থেকেই ভালোবেসে ফেলেছেন বলে পেশা বদলে অন্য কোনো কাজ করেন না এই পাঁচ কোচোয়ান।

 

তাদের ভাষ্য, যে পেশা পেটে ভাত যোগানো শুরু করলো তাকে ফেলে যাই কিভাবে? এক সময় এই ঘোড়া চালিয়েই সুখে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করেছি। তাই নিজেদের বিপদের সময়েও এই পেশার প্রতি মায়া ছাড়তে পারিনি।

 

রাজশাহীতে বর্তমানে যে পাঁচজন ঘোড়াগাড়ি চালক আছেন তারা হলেন, নগরীর কাঁঠালবাড়িয়া এলাকার আব্দুল খালেক (৭০), নওহাটা এলাকার নুর আলী (৫৫), নুরুল ইসলাম (৬০), পবা উপজেলার আন্ধারকোঠার আবু সাত্তার (৬০) এবং একই উপজেলার হরিপুর এলাকার সেন্টু (৫৮)। তাদের সবাই বর্তমানে একতাবদ্ধ হয়ে রাজশাহী শহরের এই ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ির প্রচলনটি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু খুব বেশি দিন এই ঐতিহ্য তারা বহন করতে পারবেন কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা।

 

নগরীর পিএন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ ঘেঁষে নিজ ঘোড়ার গাড়িতে বসে থাকেন আব্দুল খালেক। সম্প্রতি কথা হয় আব্দুল খালেকের সঙ্গে। জানতে চাইলে খালেক বলেন, ‘আইয়ুব খানের আমল থেকেই ঘোড়া গাড়ি চালাই। নানা আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এই গাড়িতে করে। সে সময়ে এই গাড়ি বহন করে ঘোড়ার খাবার কিনে, বাড়ির খরচ বহন করেও অনেক পয়সা বেঁচে যেত। কিন্তু এখন আর আমাদের সেই অবস্থা নেই। এখন ঘোড়ার খাওয়ার টাকা জোগাড় হতে চায় না। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে ঘোড়াকে খাওয়ায়। ঘোড়াকে বাঁচাই। অনেক সময় দোকানে বাকি করেও ঘোড়ার খাবার কিনতে হয়।’

 

ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান আব্দুল খালেক আরো বলেন, ‘আগে অনেক সম্মান পেতাম। সময়ে টাকা পরিশোধ করতাম। এখন পরিবার চালাতেও দোকানে বাকি করতে হয়। অনেকে বাকি দিতেও চায়না। রাজশাহীতে এখন অনেক ধরনের যানবাহন। তাই এখন আমাদের আর কদর নাই। আগে ঘোড়ার গাড়ি যাত্রীবাহী ছিল এখন মালবাহী গাড়ি। ভাড়া পেলে ২’শ থেকে ৩’শ টাকা পাই। আর ভাড়া না পেলে বসে থাকতে হয়। অনেক সময় যখন রিজার্ভ পাই, তখন একটু আয় হয়। সেগুলোও সব সময় তো আর জোটে না।’

 

কথা হয় আরেক কোচোয়ান সেন্টুর সঙ্গে। তিনি বলেন, স্ট্যান্ডে আগে অনেক ঘোড়া ছিল। যুদ্ধের পর অনেকে আমাদের এই জায়গা দখল করে নেয়। জায়গা হারিয়ে অনেকেই অনেক পেশায় চলে যায়। আমরা তা পারিনি। আমাদের এখন নুন আনতে পান্তা ফুরাই। এখন ছোটখাটো এলাকায় ভাড়া মারি। দিন খুব কষ্টেই যায়। অনেক সময় না খেয়েও দিন কাটাতে হয়।

 

নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা হায়দার আলী বলেন, ‘ঘোড়াগাড়ির সেই টুকটাক টুকটাক আওয়াজ আর আমাদের কানে আসেনা। বাজারের দিকে গেলেই সারা রাস্তা এমন ভাবেই আওয়াজ করে লাইন ধরে যেত গাড়িগুলো। সে সময় অনেক ভালো লাগত গাড়িরগুলোর সাজসজ্জা দেখতে। তখনকার ঘোড়াগুলোও ছিল দেখার মতো। যুদ্ধের পর গাড়িগুলো সব হারিয়ে গেল। এখন শুধুই স্মৃতি।’

 

বর্তমানে রাজশাহী শহরে চলছে যান্ত্রিক গাড়ি। গাড়ির আওয়াজ আর ধোঁয়ায় বিরক্ত আসে নগরবাসীর। তবুও জীবন থেমে থাকার নয়। ঐহিতবাহী ঘোড়ার গাড়ির বিলুপ্তিতে নগরীতে এসেছে বাহারি ধরনের গাড়ি। গাড়িগুলো সময় বাঁচালেও মানুষকে তেমন প্রশান্তি দিতে পারে না। সময়ের প্রয়োজনে মানুষকে দিন দিন আরো বেশি যান্ত্রিক আর যান্ত্রিকতা নির্ভর করে তুলছে।

 

স/আরআর