ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না রাজশাহীর রেশম শিল্প

শফিক আজম:
সময় মতো মূলধন সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি, রিলিং মেশিনের ক্ষমতার ব্যবহার ও শতভাগ সিল্কের খাঁটি বস্ত্রের মান বাজারকে অবহিত করতে না পারাসহ নানা কারণে ঝিমিয়ে পড়েছে রাজশাহী রেশম উন্নয়ন বোর্ড। শুরুতে এই শিল্পে বহু কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর প্রবেশসহ নানা সম্ভবনা দেখা দিলেও সে সম্ভবনা ফিকে হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন কোনোভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি।

 

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেশম কারখানা পুনরায় চালুর জন্য নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। সিল্কের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে গ্রহণ করা হচ্ছে নানা পদক্ষেপও। এগুলো বস্তবায়ন করা গেলে সিল্কের ঐহিত্য ফিরে আসবে। তখন সিল্কের পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।

 

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে থেকেই বৃহত্তর রাজশাহী ও বগুড়া জেলায় দুটি রেশম বীজাগার ছিল। ওই সময় থেকেই এ অঞ্চলে রেশমের চাষাবাদ হতো। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আবহাওয়া এবং জমি রেশম চাষের উপযোগী হওয়ায় তখনকার আমলে এ অঞ্চলে রেশম চাষের সম্প্রসারণ ঘটে। ওই সময় রেশম বীজাগার থেকে চাষিদের রেশম পোকার বীজ সরবরাহ করা হতো। চাষিরা এ বীজ থেকে রেশম পোকার ডিম এবং ডিম থেকে রেশমের গুটি উৎপাদন করতেন।

 

বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য মতে, ১৯৫৯-৬০ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) নিয়ন্ত্রণে রাজশাহী রেশম কারখানা স্থাপিত হয়। মডেল কারখানা হিসেবে এটি ১৯৬১ সালে যাত্রা শুরু করে। রেশম চাষিদের কাছ থেকে নগদ মূল্যে রেশম গুটি কেনা, রেশম গুটি থেকে শক্তিচালিত তাঁতে ব্যবহার উপযোগী সুতা উৎপাদন, রেশম বস্ত্র তৈরী ও বাজারজাতকরণ এবং রেশম চাষিদের প্রয়োজনে ভুর্র্তূকি প্রদান করাই ছিলো এই শিল্পের কাজ।

 

১৯৭৭ সালে রেশম বোর্ড স্থাপিত হলে এ কারখানাটি রেশম বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এ কারখানাটিতে ১০০টি রিলিং মেশিন, ২৩টি শক্তি চালিত ও ১০টি হস্তচালিত তাঁত স্থাপন করে এটি যাত্রা শুরু করে।
১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ সালে বিএমআরই প্রকল্পের অধীন ১০০টি রিলিং মেশিনকে ২০০টিতে এবং ২৩টি শক্তিচালিত তাঁতকে ৪৩টিতে উন্নীত করা হয়।

 

১৯৮০ সালে কোনরুপ আবর্তক তহবিলের সংস্থান না রেখেই এটিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়। তখন রেশম বোর্ডের উন্নয়ন খাত থেকে প্রতি বছর অর্থের যোগান দিয়ে কারখানাটি চালু রাখা হয়। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ সালে বিএমআরই প্রকল্পের অধীনে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানাটির ভবন বর্ধিতকরণসহ অতিরিক্ত ২০টি শক্তিচালিত ও ১০টি হস্তচালিত তাঁত এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কারখানাটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই চলছিল। কিন্তু তার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি আর লাভের মুখ দেখেনি।

 

ফলে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে কর্মরত ২৭২ জন শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের মাধ্যমে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কারখানা দুটি বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে রেখে সীমিত আকারে পরিচালনার জন্য সরকারের গঠিত কমিটি ১৭ কোটি টাকা ঋণ মওকুফসহ তিন কোটি টাকা অনুদান প্রদানের সুপারিশ স¤¦লিত একটি কর্মপরিকল্পনা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পেশ করেন।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত ঋণ মওকুফ না করে ব্লকড এ্যাকাউন্টে রেখে পাঁচ বছরের মরেটরিয়ামসহ ১০ বছরে পরিশোধের জন্য এবং চলতি মুলধনের তিন কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে কারখানা দুটি পরিচালনার জন্য নির্দেশ দেয়। ১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ঋণ দেয়ার জন্য রেশম বোর্ড থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু রেশম কারখানা দ’টি লোকসানী প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কোন ব্যাংকই তাদের ঋণ দিতে স¤মত হয়নি।

 

এরপর ২২ মার্চ ২০০৭ সালে কারখানা দুটি প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের মাধ্যমে বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই উদ্যেগ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে রাজশাহী রেশম কারখানার উৎপাদন ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। নানাবিধ সমস্যায় এখন এই শিল্প হারাতে বসেছে। প্রয়োজনীয় প্রচারের অভাবে রাজশাহীর রেশমের কদর বিশ্বের বাজারে পৌঁছাতে পারছে না।

 

এদিকে সেমি অটোমেটিক রিলিং মেশিনের অভাবে গুনগত মানসম্পন্ন রেশম সুতা উৎপাদন করতে পারছে না রাজশাহী রেশম কারখানা। উন্নতজাতের পোকার অভাবে নি¤œমানের গুটি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণে কাঁচামালের অপচয় হওয়া ও শ্রমিকদের ব্যবহার করতে না পারায় এই শিল্প ক্রমেই নি¤œমুখী হচ্ছে।
২০০৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রাজশাহী রেশম কারখানার মোট লোকসানের পরিমাণ ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। একই সময় পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানায় প্রায় ১১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা লোকসানের পরিমাণ নিয়ে বন্ধ রয়েছে এই শিল্প কারখানা।

 

এ বিষয়ে রাজশাহী রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক আনিস-উল-হক ভূঁইয়া সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, নানা সমস্যা ও লোকসানের মুখে কারখানা দুটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে বিভিন্ন সময় কারখানা দুটিকে চালু করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী রেশম কারখানা চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে উন্নত জাতের রেশম চাষ ও এই শিল্পের উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে মাঠ পর্যায়ে রেশম পোকা ও তুঁত চাষ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। রেশম শিল্পের উন্নয়নে ইতিমধ্যে ২৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হিলটেক্স অঞ্চলে (ঠাকুরগাঁ, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন) কাজ শুরু করেছে।

 

অপরদিকে এসব সমস্যা থাকার পরও এই শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সিল্ক শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী রাজশাহীর সিল্ক শিল্প খাতটি অর্থনৈতিক মানদ-ে অনেক পিছিয়ে। বর্তমানে এ শিল্পের বাজারটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

 

এ শিল্পের প্রসারে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বর্তমানে এটি শুধু রাজশাহীর ভোলাহাটে অল্প কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সারা দেশে এই শিল্পের উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সিল্ক রপ্তানি করা যাবে।

 

স/মি