সাঁওতাল পল্লিতে হামলার নেপথ্যে কারা?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

‘জমিই যদি লাগবে, তাহলে আমাদের দ্যাবতা (দেবতা) সাজার জন্যি অভিনয় করার দরকার পড়ছেলো কেনে? সেই প্রশ্ন করতে চাই বুলবুল চেয়ারম্যানরে। এ লোকের চোখে শরম লাগে না, এদের ভগবানের কাছে যাইতে হবেক লা? আমাদের সামনে এরে আনেন দেখি, একটা প্রশ্ন করতে চাই। হের কাছে ঘর চাই না, জমি চাই না। ও দেওয়ার ক্ষ্যামতা তার লাই। আমাদের উসকে দিয়ে তিনি এখন কোথায়?’ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আহম্মেদ বুলবুলের দিকে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালরা। তাদের অভিযোগ, রংপুর চিনিকলের জমি দখল করে নিতে তাদের উস্কে দিয়েছিলেন এই চেয়ারম্যান। আবার গত ৬ নভেম্বর এই চেয়ারম্যানের নির্দেশেই তাদের বসতবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় স্থানীয়দের নিয়ে প্রশাসন।

 

শুধু এই বুলবুল চেয়ারম্যান নন, সর্বশেষ হামলার নেপথ্যে সাঁওতালরা স্থানীয় এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, কাটাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক ও মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধানকেও ইন্ধনদাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে তারা সবাই তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

 

 

জানা গেছে, রংপুর চিনিকলের জমি অধিগ্রহণের চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে—এমন দাবিতে সাঁওতাল ও বাঙালিরা তাদের পূর্ব পুরুষের জমি ফেরত পেতে দুই বছর আগে থেকে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করেন। পরে চলতি বছরের জুলাই মাসে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের ৬ থেকে ৭শ’ একর জমি দখল করে বসতি স্থাপন করে ও চাষাবাদ শুরু করেন তারা। এমন অবস্থায় মিল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রভাবশালী সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের শরণাপন্ন হন। তিনি সাঁওতালদের জমি ছেড়ে দিয়ে মামলা করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তারা সংসদ সদস্যের কথা শোনেননি। এ কারণে সাঁওতালদের ওপর ক্ষুব্ধ হন তিনি। এরপর চার মাসে তিন দফা হামলার ঘটনা ঘটে সাঁওতালদের ওপর। সাঁওতালরাও কয়েকবার হামলা চালিয়েছেন ইক্ষু খামারের অফিসে ও সেখানে স্থাপিত পুলিশ ক্যাম্পে। তবে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনাটি ঘটে গত ৬ নভেম্বর।

 স্থানীয় সাঁওতাল ও বাঙালি প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ‘৬ নভেম্বরের ঘটনায় শাহ আলম মেম্বার ও বুলবুল চেয়ারম্যানের নির্দেশে তারা পুলিশের দিকে তীর ছুড়ে মারে। এই উস্কানি কোনও সাঁওতাল দেননি, দিয়েছেন বুলবুল নিজে। শুরুটা এভাবেই হয়েছিল।’

 

ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল তরণ মুরমু, মিকাই মুরমু, রুমিলা কিসকু ও স্থানীয় বাঙালি রুমানা বেগমের দাবি, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাবস্থাতেই স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন শাকিল আহম্মেদ বুলবুল। এরপর তিনি ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সভাপতিও হন। এই বুলবুলের ইন্ধনে তারা বাপ দাদাদের জমি ফেরত পাওয়ার আশায় ধার-দেনা করে মিলের জমিতে চালা ঘর ওঠায়। আবার তার নেতৃত্বেই রবিবার চালানো হয় উচ্ছেদ অভিযান। এ সময় আরও কয়েকজন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া এ ঘটনায় এমপির ইন্ধনও ছিল।

 

তারা আরও জানান, ‘পুলিশের উপস্থিতিতেই তাদের ঘরগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই আগুনে ঘরে থাকা চাল-ডাল, লেপ, কাঁথা, তোষক, বালিশ, খাট-চৌকি কিছুই রক্ষা পায়নি। পরের দিন ৭ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত সাঁওতালদের  স্থায়ী পল্লি মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া গ্রাম থেকে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে গরু-ছাগল, হাঁস মুরগি লুট করে নিয়ে যায়।’

 

সুলতা মার্থা নামে এক সাঁওতাল দাবি করেন, ‘‘২০১৪ সাল থেকে বাগদা ফার্মের বাপ-দাদার জমি ফেরতের দাবিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী-বাঙালি মিলে আন্দোলন গড়ে তোলে। তখন এই বুলবুল বিভিন্ন সভা সেমিনারে আমাদের দিয়ে শপথ করিয়েছেন। তিনি নিজেও শপথ করেছিলেন, ‘নিজের জীবন দিয়ে দেব তবু, বাপ-দাদার জমি উদ্ধার করে ছাড়ব।’ অথচ আজ নিজের স্বার্থ হাসিল হয়ে যাওয়ার পর সে কিনা আমাদের বুকে গুলি চালিয়ে দিল।’’

 তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা আরও জানান, ‘শাকিল আহম্মেদ বুলবুল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর সাঁওতালরা তার পা দুধ দিয়ে ধুয়ে দেন। তাকে তারা দেবতার আসনে বসিয়ে ছিলেন। সেই তিনি কিনা তাদের এত বড় ক্ষতি করলেন?’ এ সময় তারা কাটাবাড়ি ও মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের নামও ‘ইন্ধনদাতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

 

 

হামলায় আহত সাঁওতাল দ্বিজেন টুডু চিকিৎসাধীন অবস্থায় বলেন, ‘সুগার মিলের জমি ইজারা না পেয়ে সাঁওতাল ও বাঙালিদের একত্র করে সুগার মিলের কাছ থেকে জমি উদ্ধারে আন্দোলন শুরু করেন বুলবুল। নির্বাচনের আগে এ নিয়ে ব্যাপক তৎপর ছিলেন তিনি। কিন্তু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এ আন্দোলন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।’

 

সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে বলেন, ‘এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের পক্ষ থেকে শিগগিরই থানায় মামলা করা হবে। তখন জানতে পারবেন কে কে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।’

 

সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাফায়েল হাজদা বলেন, ‘এ হামলার নেপথ্যে থাকা প্রভাবশালীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা এখনও বিভিন্নভাবে আমাদের হুমকি দিচ্ছেন। তাই মামলা দায়েরের আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও জানান, ‘সাঁওতালরা ভয়ে এখনও ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। কিন্তু প্রশাসন এখনও কোনও ধরনের সহযোগিতা করছে না। ’

 

অভিযুক্তদের বক্তব্য:

সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সভাপতি শাকিল আহম্মেদ বুলবুল জানান, গত ডিসেম্বর মাসে চিনিকলে সাঁওতাল ও মিল কর্তৃপক্ষের এক আলোচনা সভায় যখন বিষয়টি পরিষ্কার হয়, মিল তার চুক্তি ভঙ্গ করলে জমি সরকারের কাছে ফেরত যাবে, ঠিক তার পরপর তিনি গত জানুয়ারি মাসে ওই কমিটির সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

 

ঘটনার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এ ঘটনায় শাহজাহান আলী নামে আরেক ব্যক্তির দিকে তিনি অভিযোগের আঙুল তুলেছেন।  তার দাবি, শাহজাহান আলী নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তার ইন্ধনে সাঁওতালরা ওই জমিতে ঘর উঠিয়েছে। এছাড়া সাঁওতালদের বিভিন্ন সংগঠনসহ কয়েকটি বাম ঘরানার রাজনৈতিক সংগঠনেরও ইন্ধন ছিল।

 

নিজের উপস্থিতির ব্যাপারে বুলবুল বলেন, ‘পরিস্থিতি শান্ত করার জন্যই বেশ কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যানসহ ওই সময় উপস্থিত ছিলাম।’

 

এদিকে, আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে কাটাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক বলেন, ‘সেদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুরোধে উদ্ভূত পরিস্থিতি শান্ত করতে ওখানে গিয়েছিলাম। এ ঘটনায় আমি জড়িত নই।’

 

একইভাবে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন মহিমাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান। তিনি দাবি করেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশতই কেউ আমাকে এখন এ ঘটনায় জড়ানোর চেষ্টা করছে।’

 চিনিকলের জমিতে সাঁওতালদের ঘরবাড়ি বানাতে মদদ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদও।

 

তিনি দাবি করেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। ঘটনার দিন আমি গোবিন্দগঞ্জেই ছিলাম না। ‘এ ঘটনার বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। পরে বিষয়টি অন্যদের কাছে শুনেছি।’  তিনি আরও বলেন, ‘গত ৮ নভেম্বর ওই এলাকার ৫০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছি।’

 

আবুল কালাম আজাদ আরও দাবি করেন, ‘ওই জমির সমস্যা সমাধানে সাঁওতালদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু, তারা কোনও কথা শোনেননি।’

 

এ ব্যাপারে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল হান্নান বলেন, ‘রবিবার সকালের সংঘর্ষের পর পরবর্তী সময়ে যেকোনও ধরনের হাঙ্গামা ঠেকাতে ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরবর্তী সময়ে জেলা পুলিশ সুপারের বিশেষ শাখা থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট  মো. আব্দুস সামাদের কাছে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে একটি আবেদন করা হয়। তখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ জন ম্যাজিস্ট্রেট ওই এলাকায় দায়িত্ব পালনের জন্য পাঠান। আমি তখন ওই এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্তব্যরত ছিলাম মাত্র।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিকালে পুলিশ ওই এলাকায় আসামি গ্রেফতারে অভিযান চালায়। এ সময় আশপাশের ৭/৮ গ্রামের লোকজন দখলদারদের একচালা ঘরগুলো পুড়িয়ে দেয়।’

 

ইউএনও আব্দুল হান্নান আরও দাবি করেন, ‘সেখানে প্রশাসন কোনও ধরনের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেনি। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তার জন্য স্থানীয় কয়েকজন চেয়ারম্যানকে ঘটনাস্থলে ডাকা হয়। ’ তবে তিনি লুটপাটের কথা অস্বীকার করেন।

 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘সাঁওতালরা ওই এলাকায় বসতি স্থাপন করার পর বেশ কয়েকবার মিলের কর্মচারীদের স্বাভাবিক চাষবাস কাজকর্মে বাধা দেয় ও তাদের ওপর হামলা করে। এছাড়া ইক্ষু খামারের অফিস ও পুলিশ ক্যাম্পেও তারা হামলা করেছে।’

 

তিনি আরও জানান, ‘গত রবিবার (৬ নভেম্বর) চিনিকলের রোপন করা আখ বীজ হিসেবে সংগ্রহের জন্য কাটতে গেলে সাঁওতালরা বাধা দেয়। এ সময় দু’পক্ষে সংঘর্ষ ঘটে। এক পর্যায়ে সাঁওতালরা পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের ওপর তীর নিক্ষেপ করে। এতে ৯ পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন তীরবিদ্ধ হন। এরপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়।’

 

তিনি জানান, ওই সময় তিনিসহ কয়েকজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সাঁওতালদের ওপর কোনও ধরনের হামলা করা হয়নি। জমি লিজের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্তে জমি লিজ দেওয়া হয়েছিল। পরে সরকারের সিদ্ধান্তেই তা বাতিল করা হয়।

 

প্রসঙ্গত, ৬ নভেম্বর রবিবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে তীরবিদ্ধ হয়েছেন ৯ জন পুলিশ সদস্য এবং গুলিবিদ্ধ হন চার জন সাঁওতাল। এদের মধ্যে তিন জন সাঁওতাল নিহত হন। পরবর্তীতে পুলিশ-র‌্যাব ওইদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এক অভিযান চালিয়ে মিলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করেন। এসময় তাদের ঘরবাড়ি আগুন লুটপাট চালায় স্থানীয় দুর্বৃত্তরা।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন