সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্রাকটিস – রোগীর লাভ-ক্ষতি কী হতে পারে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা পহেলা মার্চ থেকে নিজ প্রতিষ্ঠানে রোগী দেখতে পারবেন। অর্থাৎ ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালে ডিউটি শেষে ওই হাসপাতালেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুবিধা পাবেন, অর্থাৎ টাকা নিয়ে রোগী দেখতে পারবেন।

এজন্য তাদেরকে আর বাইরে ব্যক্তিগত চেম্বার, ক্লিনিক, ফার্মেসি কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখতে হবে না।

রোববার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জরুরি সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এসব কথা জানান। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে এই কার্যক্রমকে বলা হচ্ছে ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস।

তবে অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছেন এই সিদ্ধান্তে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সেবা ব্যহত হতে পারে।

ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস কিভাবে কাজ করবে

বাংলাদেশের সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা রোগী দেখেন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এরপর বেশিরভাগ চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখে থাকেন।

প্রাথমিকভাবে সরকারি হাসপাতালে রোগী দেখা শেষে বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

এতে একজন রোগীর বাইরে ডাক্তার দেখাতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কম খরচে ভালো সেবা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “চিকিৎসকরা বাইরে যতো ফি নেন, নিশ্চয়ই নিজের প্রতিষ্ঠানে প্র্যাকটিস করার সময় খরচ কমাবেন। তাছাড়া সব রোগীর ফি তো সমান হবে না। এতে রোগীরা কম পয়সায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারবেন। যারা ভর্তি আছেন, তারাও চিকিৎসা পাবেন। সরকারি হাসপাতালে একসঙ্গে অনেক ডাক্তার পাওয়া যাবে।”

এতে সরকারি হাসপাতালে কোন চিকিৎসককে জরুরি প্রয়োজন হলে তাকে পাওয়াটা সহজ হবে। সেইসাথে সরকারি চিকিৎসকরা ধীরে ধীরে বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নিরুৎসাহিত হবেন বলে সরকার আশা করছে।

প্রাথমিকভাবে ২০টি জেলা ও ৫০টি উপজেলা হাসপাতাল সেইসাথে পাঁচটি মেডিকেল কলেজে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে। এ নিয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে বলেও মন্ত্রী জানান।

চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ, চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠনসহ, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কর্মস্থলে রোগী দেখার ক্ষেত্রে ডাক্তারদের কী কী সুবিধা-অসুবিধা আছে, ডাক্তাররা কোথায় বসবেন, কতক্ষণ রোগী দেখবেন,  তাদের ফি কত হবে এবং কারা কারা রোগী দেখবেন এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত নিয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে বলেও মন্ত্রী জানান।

পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নে উচ্চপর্যায়ের একটি টিম ও কমিটি গঠন করা হবে এবং ওই কমিটি মন্ত্রণালয়কে সব অবহিত করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মূল্যায়ন না করেই সিদ্ধান্ত

সরকার এই প্রথমবারের মতো ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসের বিষয়টি সামনে আনলেও ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১১ সাল থেকে রোগীদের বৈকালিক সেবা দেয়া হচ্ছে।

হাসপাতালের কর্মঘণ্টা শেষে  ২৬টি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা শুক্র ও শনিবার বাদে বাকি পাঁচদিন ২০০ টাকা ভিজিটে রোগী দেখছেন । এই প্রাকটিস চলে বিকেল পর্যন্ত।

এজন্য বেলা আড়াইটা থেকে বহির্বিভাগের বিশেষ সেবার টিকেট বিক্রি শুরু হয়।

সেই বৈকালিক কন্সাল্টেশন আদৌ কতোটা ফলপ্রসূ হয়েছে সে বিষয়ে কোন মূল্যায়ন না করেই সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু করার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “যখন এই সার্ভিস শুরু হয় তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সিনিয়র অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং সেইসাথে রোগী – সবারই অনেক উৎসাহ ছিল। পরের দিকে দেখা যায় সিনিয়র কেউ আর বসেন না। তারা জুনিয়র মেডিকেল অফিসারদের বসিয়ে দিয়ে আগের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের জায়গায় চলে যায়। অর্থাৎ বাস্তবিক অর্থে এই সেবা কার্যকর হয়নি। এই বিষয়গুলো মূল্যায়নের পর সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল।”

সেবার মান কি বাড়বে?

অভিযোগ রয়েছে সরকারি হাসপাতালের বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সময় একজন চিকিৎসক যতোটা আন্তরিক থাকেন নিজের হাসপাতালে তা দেখা যায় না।

আবার অনেক সময় হাসপাতালে না গিয়ে শুধু বেসরকারি চেম্বারে রোগী দেখার অভিযোগও বহুদিনের।

এমন অবস্থায় সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু হলে অনেক চিকিৎসক এর সুযোগ নিতে পারেন, এবং তেমনটা হলে সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা আরও প্রশ্নের মুখে পড়বে বলেও আশঙ্কা করছেন মি. ফয়সাল।

তিনি বলেন, “সরকারি সেবা দেয়ার সময়ে রোগী আসলে ডাক্তার তাদেরকে ‘এখন ব্যস্ত আছি’ বলে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সময় আসতে বলতে পারেন। তারপর তিনি এক ঘণ্টা কোন রকমে রোগী দেখে চলে গেলেন প্রাইভেট চেম্বারে। এরপর তাকে দেখাতে হলে প্রাইভেট চেম্বারেই যেতে হবে।”

অথবা, তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আগের মতো মেডিকেল অফিসারদের দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালিয়ে নিতে পারেন।

এতে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার পরিসর ও মান ব্যহত হবে, রোগীরা সরকারি সেবা বঞ্চিত হবে। ফলে এই সিদ্ধান্তে কোন লাভ হবে বলে তিনি মনে করেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছেন ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসের পরও চিকিৎসকরা বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন।

সুবিধা হবে কার – রোগীর না ডাক্তারের?

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়লেও বাস্তবিক অর্থে সেবা মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেনিন চৌধুরীর মতে, সরকার সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দেয়ার পরিবর্তে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে সহজতর করার ওপর জোর দিচ্ছে।

তিনি বলেন, “সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের সব মানুষকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়া। এটা যদি সরকারের নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে সম্ভব না হয় সরকারি ও বেসরকারি জনবলের সমন্বয়ে করা দরকার। তাহলে স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিকাশ সম্ভব। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিস্তার ঘটানো সরকারের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়।”

তার মতে, আগে ঠিক করা দরকার যে সরকার কতো মানুষকে তার নিজস্ব জনবল দিয়ে চিকিৎসা দিতে পারবে। সেটা যদি ৪০% হয়, তাহলে সেই ৪০% মানুষকে যেন মানসম্পন্ন চিকিৎসা দেয়া যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।

অন্যদিকে বাকি ৬০% রোগীকে যদি বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে সেবা নিতে হয় তাহলে সরকারের উচিত হবে সেটার মান নিশ্চিত করা ও সেবা-মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা।

সরকারি খাতে যখন সেবা দেয়া হবে তখন চিকিৎসকের ভিজিট ফি এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ওষুধ ইত্যাদি সরকারি অর্থে করার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন অন্তত দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্র এবং সেইসাথে প্রতিবছর চিকিৎসা নিতে গিয়ে যে ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে চলে যায় তাদের জন্য ফ্রি সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

তেমন পরিকল্পনা না করে সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিস্তার ঘটিয়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতে আদৌ কোন মৌলিক পরিবর্তন আসবে কিনা সেটা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিজের কর্মস্থলে বা বাইরে কোথাও প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস করেন এমন কোনো নজির উন্নত দেশগুলোয় নেই।

তবে তাদেরকে প্রচুর বেতন দিয়ে ভালো চিকিৎসা দিতে উৎসাহ দেয়া হয়।

সেক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে যদি অধিকতর রোগীকে সেবা দেয়ার প্রসঙ্গ আসে তাহলে সেখানকার চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পরিবর্তে বরং প্রাইভেট হাসপাতালের মতো বেতন দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন মি. চৌধুরী।

আবু জামিল ফয়সালের মতে, কোনো সরকারি চিকিৎসককে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বাইরে কোনো কাজ করতে না দিয়ে তারা যেন পুরো সময়টা গবেষণা ও সরকারি চিকিৎসা সেবায় ব্যয় করতে পারেন, এজন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা দেয়া প্রয়োজন।

অন্যদিকে – তিনি বলেন- সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিজেদের কর্মস্থলে রোগী দেখার পর আবার বেসরকারি হাসপাতালেও রোগী দেখার বারণে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না বলে তিনি জানান ।

সাধারণত সুচিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে একজন ডাক্তারের বিপরীতে তিনজন নার্স, পাঁচজন টেকনোলজিস্টের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে এই অনুপাত নেই বললেই চলে।

সরকারি হাসপাতালে যথেষ্ট জনবল নেই। এ অবস্থায় সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে রোগী দেখার সময় ডাক্তার অন্যদের কাছ থেকে কতটা সাহায্য পাবেন তা নিয়ে এই নতুন সিদ্ধান্তে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এমন আরও নানা কল্যাণমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের হার কমিয়ে আনা হবে।

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ছয় হাজার চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। এরপরও প্রতিবছর অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নেন।

সরকারি হাসপাতালে মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবার অভাব এবং সেইসাথে বেসরকারি হাসপাতালে অত্যধিক খরচের কারণে বিদেশে বিশেষ করে ভারতে, চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা