সরকারি গুদামে চাল নেই কেন?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: চাল নিয়ে মহাসংকটে পড়েছে দেশ, সরকারি গুদামেও কমে গেছে চালের মজুদ। চলতি জুন মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত সরকারি গুদামে মজুদ আছে এক লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন চাল, যা গত ৬/৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরের এই সময়ে সরকারের গুদামে থাকা চালের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন। এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, গুদামে কেন চাল নেই?

খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচি বাবদ প্রতিবছর প্রয়োজন হতো ৮ লাখ টন চাল। আর খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস), ভিজিএফ ও সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার সদস্যদের রেশন বাবদ মজুদ রাখা হতো ৮ লাখ টন চাল। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে কাবিখা কর্মসূচি হয়ে গেছে কাবিটা (কাজের বিনিময় টাকা) কর্মসূচি। এখন ওই কর্মসূচিতে চালের পরিবর্তে দেওয়া হয় টাকা। ফলে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে কাবিখার ৮ লাখ টন চাল সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। এজন্যই ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সরকারি গুদামে ৮ লাখ টন চাল কম থাকবে, এই স্বাভাবিক।

বর্তমানে সরকারি গুদামে যে এক লাখ ৯১ হাজার টন চাল মজুদ আছে এটিকে স্বাভাবিকই বলছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘চলতি মৌসুমে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ৮ লাখ টন চাল ও ৭ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মিলাররা যে সরকারি গুদামে ধান ও চাল সরবরাহ করেনি তা সবাই জানে।’ যদিও এর জন্য মিলাররা হাওরের বন্যা ও দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্লাস্ট রোগে ধান নষ্ট হওয়াকে দায়ী করছেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরও জানান, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২২ হাজার ৪৬৩ চালকল মালিকের সঙ্গে বোরো চাল সংগ্রহের জন্য চুক্তি করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা সরকারি গুদামে ৮ লাখ টন চাল সরবরাহ করবে বললেও এখনও পর্যন্ত মাত্র ৭ হাজার ২৭৮ টন চাল সরবরাহ করেছে।

 এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, ‘মজুদে সমস্যা নাই, মজুদ এখনও ঠিক আছে। সরকারের মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তবে হাওরের বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সরকার জিটুজি পদ্ধতিতে ভিয়েতনাম থেকে ৬ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। যা অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশে এসে পৌঁছাবে।’

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন। দেশে চালের চাহিদা ২ কোটি ৭০ লাখ টন। এই হিসাবে কমপক্ষে ৮০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা রয়েছে, কিন্তু তা নেই। সরকারি গুদামে এই চাল না থাকলেও দেশের অভ্যন্তরেই এই চাল আছে। চালের কোনও সংকট নাই। তবে বাজার ঘুরে এসব কথার সত্যতা পাওয়া যায়নি।

চাল তাহলে কোথায় আছে, জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মিলারদের সঙ্গে মিলে বড় বড় ব্যবসায়ীরা চালের অবৈধ মজুদ গড়েছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এখন চালের ব্যবসা করে। তাদের ব্রান্ড নাম ব্যবহার করে এখন চাল বিক্রি হয়, তাদের সুপার শপও রয়েছে। তারা যদি তাদের নিজস্ব গুদামে ৫০ হাজার টন চাল মজুদ রাখে সেই গুদাম থেকে চাল বের করে আনা সহজ নয়। এভাবেই এই সংকট তৈরি করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাওরের বন্যায় মাত্র ছয় লাখ টন বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। তাই ছয় লাখ টন চাল আমদানি করলেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। তাই ৬ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে গত ১৪ জুন আড়াই লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। আমদানি করা এই চালের দাম পড়বে প্রতিকেজি ৩৭.৬০ টাকা।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘সরকার স্বীকারই করতে চায় না যে চালের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। হাওর অঞ্চলের ৭ জেলায় এ বছর আগাম বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। আর ১৯টি জেলায় ধানক্ষেতে ছত্রাকের আক্রমণে (ব্লাস্ট রোগ) উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুই কারণে এ বছর ১০ লাখ টনের বেশি বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। এ অবস্থায় ভিয়েতনাম থেকে জরুরি ভিত্তিতে ৩ লাখ টন চাল আমদানির সমঝোতা স্মারক নবায়ন করেছে সরকার।’

জানা গেছে, মিলাররা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ধান-চাল মজুদ করে থাকতে পারেন এ তথ্যের ভিত্তিতে তাদের প্রকৃত মজুদ জানতে চেয়েছে সরকার। তবে মিল মালিকরা বলেছেন, ‘সরকার প্রতি কেজি চালের দর নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা, অথচ বাজারে দাম ৪৫ টাকার ওপরে। এ অবস্থায় বেশি দাম দিয়ে চাল কিনলে লোকসানের সম্মুখীন হবো। মজুদের প্রশ্নই ওঠে না।’

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খাদ্য অধিদফতরের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে চালকল মালিকদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারা কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশে চাল নিয়ে কারসাজি করছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন