সরকারকে ত্রিমুখী চাপে ফেলতে চায় বিএনপি

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

সরকারকে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক- এই তিন দিক থেকে নতুন করে চাপে ফেলতে চায় বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে দলটির পক্ষ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, চলমান আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ পথে রেখে জনসমর্থন বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করাই দলটির লক্ষ্য।

বাংলাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো এমন কর্মসূচি পালন করে। ২৭ বছর পর এবার বিএনপি ও জামায়াত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরই পুনর্বহাল দাবিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই কর্মসূচির ডাক দিল।

সরকারকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করতে বিএনপি গত বুধবার এ আন্দোলনের ডাক দেয়। এ সময় দলটি প্রশাসন, দেশবাসী ও দলীয় নেতাকর্মীদের ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা, সরকারকে কর, খাজনা, ইউটিলিটি বিল এবং অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত রাখা, ব্যাংকে টাকা জমা না রাখা, রাজনৈতিক মামলায় নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, দেশের সকল মানুষের ভোটের মৌলিক অধিকারসহ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রাম অর্জন না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমাদের রাজপথের আন্দোলন চলতে থাকবে।

বিএনপি মনে করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চেয়েছিল গণতান্ত্রিক বিশ^। বিএনপি, বাম ও ইসলামপন্থি দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে এবারের নির্বাচনও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা,

তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। এটি সরকারকে আরও বেশি কূটনৈতিক চাপে ফেলবে। পাশাপাশি দেশে অর্থনৈতিক সংকটও রয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির পক্ষ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে করছে দলটি। এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলও।

বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় আছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে সবকিছু সরকারের পক্ষে একাট্টা। রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগের অবস্থান খাটো করে দেখার মতো নয়। এ ছাড়া দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে বড় অংশ নির্বাচনের মাঠে। এ অবস্থায় অসহযোগ আন্দোলন পুরোপুরি কার্যকর করা খুব কঠিন বলেই মনে করা হচ্ছে।

তারা আরও বলেন, এর পরও দলীয় নেতাকর্মী ও প্রবাসীরা যদি অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখে, তা হলে চলমান ডলার সংকট আরও বাড়বে। দেশের অভ্যন্তরে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কিছু অংশও যদি ট্যাক্স এবং ইউটিলিটি বিল দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, তা হলে অর্থনৈতিকভাবে সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি মামলায় প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসব নেতাকর্মীও যদি আদালতে হাজিরা দিতে না যান, তা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলন ও নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে, নাকি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করবে। দুই কাজ একসঙ্গে করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না।

তদুপরি বর্তমানে বিএনপির ২৩ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী কারাগারে। সেখানে এখন বন্দিসংখ্যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ। এমতাবস্থায় আরও নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে সরকার কোথায় রাখবে? সব মিলিয়ে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন সরকারকে নতুন করে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে ফেলবে।

সরকারের পদত্যাগ দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে ডাকা মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল ও ১১ দফায় ২৩ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এসব কর্মসূচি শুরুতে কার্যকর হলেও বর্তমানে মাঠে আন্দোলনের তেমন কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।

বরং আন্দোলন চলাকালে চলন্ত ট্রেন ও বাসে আগুন এবং আন্দোলনের মাঠে নেতাকর্মীদের কম উপস্থিতিতে চিন্তায় পড়েছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। এ থেকে উত্তরণে করণীয় নির্ধারণে বিএনপি ও সমমনা দলের নেতাদের সাথে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই সময় হরতাল, অবরোধ, গণমিছিল, সমাবেশ ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো সরকারবিরোধী নানারকম কর্মসূচির বিষয়ে মতামত দেন নেতারা; কিন্তু সমমনা একটি জোটের পক্ষ থেকে এখনই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক না দেওয়ার পক্ষে মত দেওয়া হয়।

সমমনা দলের এক নেতা বলেন, চলমান আন্দোলনের মূল দল বিএনপি। যে কোনো কর্মসূচি দেওয়ার ব্যাপারে সমমনা দলের পক্ষ থেকে পুরোপুরি দায়িত্ব দেওয়া আছে। বিএনপির পক্ষ থেকে যেহেতু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে, তারাও সমর্থন জানিয়ে কর্মসূচি দিয়েছেন।

জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, সরকারের প্রতিবন্ধকতা ও জুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে প্রহসনের নির্বাচনের যে আয়োজন করেছে, জনগণ তা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেবে না।