সুদানে সংঘাত

সব হারিয়েও প্রাণে বেঁচে ফেরার স্বস্তি

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

বছর সাতেক আগে নাসিমাকে বিয়ে করেন সুদান প্রবাসী জাকির মিয়া। কঠোর পরিশ্রম করে সুদানের রাজধানী খার্তুমে একটি দোকানের মালিক বনে যান তিনি। সিলেটের এ বাসিন্দা ২০১৯ সালে স্ত্রীসহ এক বছরের সন্তানকে সুদান নিয়ে যান। দেশটিতে যাওয়ার পর এ দম্পতির আরেক সন্তান পৃথিবীতে আসে। দুই সন্তানকে নিয়ে সুদানে ভালোই চলছিল জাকির-নাসিমার দাম্পত্য জীবন। কিন্তু সুদানের সংঘাত তাদের সুখের সংসারকে ভিন্ন পথে ঠেলে দিয়েছে।

যুদ্ধকবলিত সুদান থেকে দেশে ফেরা ১৩৬ জনের একজন নাসিমা। তিনি দুই সন্তান ও তার ছোট ভাইকে নিয়ে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু নাসিমার স্বামী তাদের সঙ্গে দেশে ফেরেননি। নাসিমা বলেন, ওখানে আমরা ভালোই ছিলাম। হঠাৎ করে সব অন্যরকম হয়ে গেল। কোনোরকমে সন্তানদের নিয়ে চলে এলাম। ওদের বাবা ওখানে রয়ে গেলেন। দোকান রেখে উনি আসতে চাইলেন না। ওনার জন্য চিন্তা হচ্ছে, যদি কিছু হয়ে যায়।

সুদানফেরত লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা মো. শাহজাহান খার্তুমে থাকতেন। খার্তুমে নিজ চোখে সংঘাত দেখা শাহাজাহান এখনো ট্রমার মধ্যে আছেন। কথা বলতে গেলে তার চোখ বেয়ে নেমে আসে জল। বিমানবন্দরে আলাপকালে তিনি বলেন, কীভাবে যে বেঁচে আসছি সৃষ্টিকর্তা বলতে পারবেন। শূন্য হাতে জীবনটা নিয়ে কোনোরকমে ফিরে এসেছি। চোখের সামনে গোলাগুলি দেখেছি। যা কিছু সঙ্গে ছিল সবই এক দল নিয়ে গেছে। কয়টা জামা ছাড়া কিছুই আনতে পারিনি।

খার্তুমে দর্জির কাজ করা শাজাহান দেশে ফিরতে পারায় কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেও সামনের দিনগুলো নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তা তার মাথায় জেঁকে বসেছে। কেননা, তাকে ছয় জনের একটি পরিবারে অর্থের জোগান দিতে হবে।

যুদ্ধকবলিত সুদান থেকে জেদ্দা হয়ে সোমবার (৮ মে) প্রথম দফায় দেশে ফিরেছেন ১৩৬ বাংলাদেশি। বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইটে সকালে তারা দেশে ফেরেন। দেশে ফেরাদের মধ্যে নারী, পুরুষ, শিশু ও শারীরিকভাবে অসুস্থ প্রবাসীরা ছিলেন।

দেশে ফেরত আসা বেশ কয়েকজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, দেশটিতে তারা যে পরিস্থিতি দেখে এসেছেন, সেখানে থাকার মতো অবস্থা নেই। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, খাবার নেই, নিরাপত্তা নেই। চলমান সংঘাতের কারণে সুদান থেকে খালি হাতে ফেরার আক্ষেপ রয়েছে এসব প্রবাসীর। তবে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারায় স্বস্তিবোধ করছেন কেউ কেউ।

খার্তুমের একটি কারখানায় কাজ করতেন মো. আরিফ। তিনি জানান, আমি যে কারখানায় কাজ করতাম সেখানে ১৮ এপ্রিল গুলি পড়ে। এরপর মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ করে দেয়। ১৫ এপ্রিল থেকে একটা অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে ছিলাম। দেশে আসা পর্যন্ত কি যুদ্ধটা না করতে হয়েছে। এক বেলা খেয়েছি তো আরেক বেলা খেতে পারিনি। প্রথমে ভেবেছি থেকে যাব। কিন্তু সেখানে যে পরিস্থিতি, থাকার মতো অবস্থা নেই।

মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা আলিফ শেখ জানান, ওখানে পানি নাই, খাবার নাই, গুলি চলে, ওখানে কি থাকা যায়। বাসার ছাদে গুলি পড়ছে। খার্তুম থেকে পোর্ট সুদানে দুই দিনে পৌঁছাই। পোর্ট সুদান থেকে জেদ্দায় যাওয়া পর্যন্ত খুব কষ্টে ছিলাম। একটি স্কুলে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হয়েছে। কত মানুষ ওখানে আছে। সবাই খুব কষ্টের মধ্যে দিন পার করছে।

গত ৩ মে সুদানের রাজধানী খার্তুম থেকে ৬৮০ বাংলাদেশিকে নিরাপদে পোর্ট সুদানে নেওয়া হয়। দুই দফায় মোট ১৩টি বা‌সে ক‌রে তাদের সেখানে নেওয়া হয়। প্রায় চার দিন পোর্ট সুদানে অপেক্ষা করার পর রোববার (৭ মে) তিনটি পৃথক ফ্লাইটে অন্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে ১৩৬ বাংলাদেশিকে জেদ্দায় পাঠানো হয়। রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস ও ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওম) সহযোগিতায় জেদ্দা থেকে এসব বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হয়। এখনো প্রায় সাড়ে ৫০০ বাংলাদেশি পোর্ট সুদান থেকে জেদ্দা হয়ে দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে।

সুদান থেকে বাংলাদেশিদের প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাভেল পারমিট ইস্যু ও জাহাজের সিডিউল পেতে দেরি হওয়ায় পোর্ট সুদান থেকে বাংলাদেশিদের জেদ্দায় নিতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে বাকিদেরও দেশে ফেরানোর প্রচেষ্টা চলমান আছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী দুএকদিনের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় জেদ্দা হয়ে দেশে ফিরবে কিছু বাংলাদেশি।

সুদান ফেরত প্রবাসী আব্দুর রউফ বলেন, সেখানকার পরিস্থিতি খুব খারাপ। খুব ভয়াবহ অবস্থা। কিছুই আনতে পারিনি। টাকা-পয়সা, মোবাইল সব নিয়ে গেছে এক দল। একেবারে নিঃস্ব হয়ে এলাম। সব কিছু শেষ। দেশের ফেরার জন্য সরকার সহযোগিতা করেছে। তবে পোর্ট সুদানে গত কয়দিন খুব কষ্ট করতে হয়েছে।

প্রায় এক যুগ পরিবার নিয়ে সুদানে কাটিয়ে দেওয়া আইয়ুব আলী জানান, তিনি আর বিদেশ যেতে চান না। দেশে ছোট কোনো ব্যবসা করে বাকি জীবন পার করে দেবেন।

খার্তুমে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স) তারেক আহমেদের দেওয়া তথ্য বল‌ছে, সুদানে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার বাংলাদেশি রয়েছে।

সুদানের সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর লড়াইয়ের শুরুর দিকে গত ১৫ এপ্রিল দেশটির রাজধানী খার্তুমে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদের বাসা আক্রান্ত হয়। রাষ্ট্রদূতের বাসার দেয়াল ও জানালা ভেদ করে ঢুকে পড়ে মেশিনগানের গুলি। এরপর গত ২২ এপ্রিল সুদানের সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর লড়াইয়ের সময় বাংলাদেশ দূতাবাসের জানালা ও দেয়াল ভেদ করে মেশিনগানের গুলি ঢুকে পড়ে।

সুদান ফেরতদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা সরকারের

সুদান থেকে জেদ্দা হয়ে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীদের ঢাকার হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাগত জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। সুদান থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশিদের পুনর্বাসনে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি নীতিমালা করার কথা প্রবাসীদের সামনে তুলে ধরেন মন্ত্রী।

মন্ত্রী জানান, সুদানে আটকা পড়া বাংলাদেশিদের ফেরাতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে দুই লাখ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে।

ইমরান আহমদ বলেন, এরা সব কিছু হারিয়েছে। কিন্তু এ হারানোর আগে দেশকে অনেক কিছু দিয়েছে। এরা সবাই খালি হাতে এসেছে। কীভাবে এদের সাহায্য করা করা যায়, সেটার জন্য আমরা এখানে এসেছি। আইওএম এদের সর্বত্র সহায়তা করছে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে সবাইকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে যেন এ কয়দিন তারা চলতে পারেন। আমরা চেষ্টা করছি তাদের অসুবিধাটা যতটুকু লাঘব করা যায়।

দেশে ফেরত আসা ১৩৬ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড তিন হাজার টাকা তুলে দেয়। এছাড়া আইওএম থেকে দেওয়া হয় দুই হাজার টাকা ও খাদ্য সহায়তা।

প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বলেন, আপনাদের পুনর্বাসনের জন্য আমাদের প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আছে, আমরা একটা নীতিমালা ঠিক করে দিলে আপনারা ওখান থেকেও সাহায্য নিতে পারবেন। পরবর্তীতে সুদানের অবস্থা ভালো হলে আপনারা আবার যেতে পারবেন। এর বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো দেশে যদি যাওয়ার ব্যবস্থা হয়, তাহলে আমরা সেই ভাবে ব্যবস্থা করব।

প্রবাসীদের উদ্দেশে ইমরান আহমদ বলেন, আমি আপনাদের অনুরোধ করব, আপনারা নাম-ঠিকানা রেজিস্ট্রেশন করবেন, যাতে ভবিষ্যতে আপনাদের আমরা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারি। আগামীতে কীভাবে কী করব সেটার জন্য যেন আমরা সরাসরি যোগাযোগ করতে পারি।