‘সফল’ মন্ত্রী ‘ব্যর্থ’ এমপি

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে যারা সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বা আছেন, তাদের অনেকেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। এই মেয়াদের কয়েকজন মন্ত্রীও এলাকায় বিতর্কিত কর্মকান্ড করে সমালোচিত হয়েছেন। ফলে এবারের নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি না থাকলেও তারা আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।

টানা তিনবারের সংসদ সদস্য (এমপি), সরকারের পররাষ্ট প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সফলতা দেখিয়েছেন। সমালোচনা, বিতর্ক এসব থেকে দূরেই থেকেছেন সব সময়ই। সারা দেশে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। শিক্ষিত-মার্জিত হিসেবে সুখ্যাতিও আছে শাহরিয়ার আলমের। কিন্তু জনপ্রিয় হতে পারেননি নিজের নির্বাচনী এলাকা রাজশাহীর বাঘা ও চারঘাট উপজেলার সাধারণ মানুষের কাছে। জনপ্রিয়তা খুইয়েছেন নিজের দলের নেতাকর্মীদের কাছেও।

এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ রাত সোয়া ৮টায় তাকে ফোন করা হয়।

দুটি উপজেলা নিয়ে রাজশাহী-৬ আসন। এবারও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে টানা চতুর্থবার আসনটিতে নির্বাচন করছেন শাহরিয়ার আলম। গত তিনবার জয়ী হলেও এবার সেখানে তার জয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা রাহেনুল হক রায়হান। তার প্রতীক কাঁচি। ভোটের মাঠে শাহরিয়ার আলমকে পিছিয়ে রেখেছেন রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ। তার বাড়ি চারঘাট উপজেলার শালুয়া ইউনিয়নে। বিএনপির প্রভাবশালী এই নেতা আবু সাঈদ চাঁদ জেলে

থাকলেও তার অনুসারীরা এ আসনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর জয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন এমন আলোচনাও রয়েছে। এলাকার মানুষের দাবি, এ এলাকায় সবচেয়ে বেশি বিএনপির সাধারণ ভোটররা কেন্দ্রে ভোট দিতে যেতে পারেন। কারণ, চাঁদও চান শাহরিয়ারের পরাজয়।

১৫ বছর রাজশাহী-৬ আসনে প্রভাবের সঙ্গে রাজনীতি করলেও এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের নির্বাচনী এলাকায় বহিরাগত তকমা লেগেছে শাহরিয়ার আলমের গায়ে। আছে একাধিক বিয়েসংক্রান্ত সমালোচনাও। এলাকায় কম যাতায়াতও তাকে ভোটের মাঠে পিছিয়ে রেখেছে।

স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে এলাকায় সময় দেওয়া শাহরিয়ার আলমের জন্য হয়ে ওঠে না। কিন্তু ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ এমন প্রবাদ স্মরণ করিয়ে দেন তারা।

ভোটাররা বলছেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এলাকায় এলেও গাড়ি থেকে নেমে মানুষকে সময় দেওয়া কী অনেক কষ্টের? এলাকায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শাহরিয়ারের পছন্দ-অপছন্দও এলাকায় অজনপ্রিয় করে তুলেছে তাকে।

স্থানীয় লোকজনের দাবি, বাঘার আড়ানী পৌরসভার মেয়র মোক্তার আলী, চারঘাট পৌরসভার মেয়র একরামুল হক একরাম ও চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলামের কারণে শাহরিয়ার আলমের এলাকার রাজনীতি নষ্ট হয়েছে। তার আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে এই তিন জনপ্রতিনিধি এলাকার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। সেবার চেয়ে যন্ত্রণাই বেশি দিয়েছেন এই জনপ্রতিনিধিরা। শাহরিয়ারের জয়ের পথে এখন প্রধান বাধা তারাই।

দলের নেতাকর্মী হলেও ভিন্ন মতপ্রকাশ করলেই মামলা-হামলার অভিযোগও রয়েছে শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে। ভোটের মাঠে এখন নতুন যে অঘটন ঘটাচ্ছেন একরামুল হক, মোক্তার আলী ও ফখরুল ইসলাম মিলে, সেটি আরও ঝামেলায় ফেলে দিচ্ছে নৌকার এই প্রার্থীকে। আর তা হলো, ভোটারদের ভোটার আইডি নিয়ে তাদের কাছে রাখছেন। স্থানীয়রা ভোটার আইডি নেওয়ার কারণ জানেন না, কিন্তু ভয়ে রয়েছেন তারা।

চারঘাট উপজেলার মালেকার মোড় বাজারে বসে কথা হয় মো. সাকিন উদ্দিনের সঙ্গে। সেখানে মোটামুটি মানের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালান তিনি। শালুয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের এই ভোটার বলেন, ‘শাহরিয়ার আলম খারাপ মানুষ নন। কিন্তু খারাপ মানুষকে প্রশ্রয় দিয়ে তিনি আজ খারাপ পরিস্থিতিতে আছেন। স্থানীয় নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব আছে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর। যেসব নেতার হাতে দায়িত্ব ছেড়ে তিনি রাজনীতি করেছেন, তাদের সবার আচরণ খারাপ। এ জন্য শাহরিয়ারের অবস্থা খারাপ।’

সাকিন বলেন, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রায়হান এ এলাকার সন্তান। সাবেক এমপি। মুক্তিযোদ্ধা। সুষ্ঠু ভোট হলে রায়হানের জয় কেউ আটকাতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন।

সাকিনের মতে, রায়হানকে ভোট দিতে বিএনপির সাধারণ ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন। তাই কায়দা-কানুন ছাড়া জয়ের সম্ভাবনা একেবারেই নেই শাহরিয়ার আলমের।

চরঘাট পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার কালু গাজী পেশায় ব্যবসায়ী। নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, ভোটের অবস্থা ভালোই। কে জিতবে এমন প্রশ্নে হুট করেই কালু বলে ফেলেন, ‘কাঁচি জিতবে। কাঁচি প্রতীক নিয়ে ভোট করছেন রায়হান।’ প্রতিমন্ত্রী এত কাজ করলেন, তাহলে কেন জিতবেন না? তাতেও কালু গাজীর স্পষ্ট জবাব, ‘এত দিন তো বড়লোক (শাহরিয়ার আলম) ছিল। এখন গরিবের (রায়হানুল হক রায়হান) দিকে তাকাই। বড়লোকের গুণ যদি ভালো থাকত, তাহলে তার গুণ গাইত সবাই।’

গরিব পাস করলে বড়লোক হয়ে যাবে না তো? কালুর পরিষ্কার উত্তর, ‘ও বড়লোক হবে না। টাকার বস্তা দিলেও ওকে কিনতে পারবে না।’ প্রতিমন্ত্রীকে কে ‘কিনে ফেলেছে’, জানতে চাইলে বলেন, ‘যে কটা লোক কেনার দরকার কিনে ফেলেছে।’ বিএনপির ভোটার কি ভোট দিতে আসবে জানতে চাইলে কালু বলেন, ‘পা ফাটারা আসবে।’ পা ফাটারা মানে কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মতো সাধারণ জনগণ আসবে।’

শাহরিয়ার আলমকে নিয়ে কী সমস্যা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সমস্যা ম্যালা। কোনটা বলব। বলেন, ১৫ বছর হয় আসল, রাজত্ব করল। অর লোক হলো একরামুল হক, চারঘাট পৌরসভার মেয়র। আর ফখরুল ইসলাম, চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান।’ কালু গাজী বলেন, ‘এবার বড়লোক তাড়াতে চাই, গরিবকে ক্ষমতায় আনতে চাই।’

ভোটের বিষয়ে জানতে চাইলে চারঘাট পৌরসভার মেয়র একরামুল হক একরাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ আসনে নৌকার হেরে যাওয়ার কোনো কারণে দেখছি না।’ তার দাবি, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীরা উগ্রতা দেখাচ্ছে, প্রচারণায় এগিয়ে আছে, এটা সত্য। আমাদের ভোটাররা বাসা-বাড়িতে বসে আছে। তাই নৌকার অবস্থা খারাপ মনে হচ্ছে।’

এই মেয়র বলেন, ‘আমরা ভোটের দিনের অপেক্ষা করছি। সেদিন দেখিয়ে দেব।’ ভোটার আইডি কার্ড সংগ্রহের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানা নাই।’

চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম বলেন, এখানে নৌকাই বিজয়ী হবে। তিনি বলেন, তার ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিংসা ও প্রতিহিংসার কারণে। বিএনপি-অধ্যুষিত এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তাদের ভূমিকা বেশি বলে দাবি করেন তিনি।

দুটি উপজেলার সাধারণ মানুষ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভাষ্য, শাহরিয়ারকে বিজয়ী করতে হলে কায়দা-কানুন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তা ছাড়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর জয়ের সম্ভাবনা স্থানীয়রা কম দেখছেন। রাজশাহী-৬ আসনের দুটি উপজেলার কয়েকটি ওয়ার্ড-ইউনিয়ন ঘুরে এবং স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবেক এমপি রায়হানের কাঁচি প্রতীকের প্রচারণার ধারেকাছে নেই শাহরিয়ার আলমের নৌকার প্রচারণা।

বেশ কয়েকজন ভোটার বলছিলেন, সন্তান দূরে থেকে মা-বাবার জন্য সব দায়িত্ব পালন করে, নিয়মিত হাতখরচের টাকা পাঠায়। কিন্তু বছরের পর বছর বাবা-মাকে সাক্ষাৎ দেন না। দূর থেকে টাকা পাঠিয়ে খবর নেওয়ার চেয়ে মা-বাবা সন্তানকে কাছে পেতে চান বেশি। না পেলে তাদের বুক ভেঙে যায়। শাহরিয়ার আলমকে নিয়েও বিষয়টা এমন। স্বতন্ত্র প্রার্থী রায়হানকে নিয়ে স্থানীয়দের প্রত্যাশা তাকে সব সময়ই কাছে পাওয়া যাবে।

প্রতিমন্ত্রী অজনপ্রিয় কেন হয়ে উঠলেন জানতে চাইলে স্থানীয় লোকজন বলেন, তিনি যাদের ডানে-বামে রেখে এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তাদের আচরণ অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিয়েছে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। যেসব নেতার হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় বসে থেকেছেন, তারাই তার জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছেন।

রাজশাহীর মুরব্বিখ্যাত (আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা) নেতার আশীর্বাদও নেই শাহরিয়ার আলমের পক্ষে। আওয়ামী লীগের প্রবীণ-নবীন সব নেতাই বলেন, নৌকা জিতলে ধরে নিতে হবে কায়দা করা হয়েছে।