সন্তানকে কার কাছে রেখে কাজে যাচ্ছেন কর্মজীবী মায়েরা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সরকারী চাকুরে উর্মি দে থাকেন ঢাকার হাতিরঝিল লাগোয়া একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে। তার ফ্ল্যাটের প্রতিটি কামরায় ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসানো।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরীজীবী। বাসায় গৃহকর্মীর কাছে থাকে তাদের ছোট্ট কন্যা রূপকথা। তাই নিশ্চিন্ত থাকার জন্য এই ব্যবস্থা।

সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও সরাসরি সম্প্রচার হয় মায়ের মোবাইল ফোনের পর্দায়।

এভাবেই সন্তানকে নজরে রাখা ও সরকারী দায়িত্ব পালন একসাথে সারেন উর্মী দে।

মিসেস দে’র এই ব্যবস্থাটি অভিনব। কিন্তু মূল সমস্যাটি থেকেই যাচ্ছে। তার সন্তানটি বেড়ে উঠছে একজন অপ্রশিক্ষিত গৃহকর্মীর কাছে।

কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই এবং বাংলাদেশেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মজীবী মায়েরা এ ধরণের পরিস্থিতিতে পড়লে তার সন্তানকে দিবা-যত্ন কেন্দ্র বা ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে যাচ্ছেন।

উর্মি দে বলছেন, তিনিও চেয়েছিলেন মেয়ে ডে-কেয়ার সেন্টারে দিতে। অনেকগুলোতে ঘুরেও ছিলেন তিনি। কিন্তু কতগুলোর মান নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। কতগুলোর খরচ তার পক্ষে বহন করা সম্ভব না। আর কোন নীতিমালা না থাকায় বেসরকারী ডে-কেয়ার সেন্টারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও তার সন্দেহ দূর হয়নি।

তাই সিসিটিভি পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন তিনি। এভাবে চাকরি চালিয়ে যেতে পারছেন তিনি।

কিন্তু রিভানা জেবিন হক পারেননি।

২০০৫ সালে যখন প্রথম সন্তান আসে তখন ইন্টারনেটের এত বাড়-বাড়ন্ত ছিল না, বেসরকারি ডে-কেয়ারও তেমন একটা ছিল না মিসেস হকের ভাষায়।

ফলে সেই আমলের বিবিএ-এমবিএ পাশ করা মিসেস হক ঢাকার থাই দূতাবাসের লোভনীয় চাকরিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আজ তার পরিচয় শুধুই একজন গৃহবধূ।

‘নিউক্লিয়াস’ পরিবার:

উর্মি দে বলছিলেন, তাদের ‘নিউক্লিয়াস’ পরিবার। বাড়িতে মা-বাবা কিংবা শ্বশুর-শাশুড়িকে পান না তারা। ফলে সন্তানের দেখভাল তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য যাদের সাথে কথা বলা হয়েছে, যে সব বিশ্লেষক এবং কর্তৃপক্ষের মন্তব্য নেয়া হয়েছে তারা সবাই এক বাক্যে বলেছেন, এক সময় বাংলাদেশে যৌথ পরিবারের ধারণা থাকলেও আস্তে আস্তে সেটা হারিয়ে যাচ্ছে।

ঢাকার মত বড় শহরগুলোতে এখন আর যৌথ পরিবার দেখা যায় না বললেই চলে।

আর এ কারণে, কর্মজীবী মায়েদের চ্যালেঞ্জও বেড়েছে।

ঘরোয়া ব্যবস্থা:

এসব মায়ের সমস্যা সমাধান কল্পেই ঢাকায় আজকাল অনেক ডে-কেয়ার সেন্টার দেখা যায়।

যদিও এগুলোর বেশীরভাগই অবস্থিত গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডির মত ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোয়।

‘ডে কেয়ার সেন্টার ইন ঢাকা’ লিখে গুগলে সার্চ দিতে কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে ওঠে বেশ কটি নাম।

এদের একটি ধানমন্ডির কিডস প্যারাডাইস।

একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ডে কেয়ার সেন্টারটি চালান তনিমা ফারহানা।

এক রুমে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে তিনি থাকেন।

বাকী রুমগুলো ডে কেয়ার সেন্টার।

একেবারে ঘরোয়া ব্যবস্থা।

মিসেস ফারহানা বলছিলেন, তিনি ইটালিতে ছিলেন কয়েক বছর। সেখানে একটি প্রি-স্কুলে তিনি চাকরী করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এই ডে কেয়ারটি করেছেন।

এই ডে কেয়ারটিতে শিশুপ্রতি সর্বোচ্চ খরচ সাড়ে সাত হাজার টাকা। নানা রকম প্যাকেজ রয়েছে এদের।

সরকারী উদ্যোগ:

সরকারী উদ্যোগের মোট ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে বাংলাদেশে। অধিকাংশই অবশ্য ঢাকায়।

এগুলো পরিচালনা করে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।

একটি রয়েছে অধিদপ্তরের সদর দপ্তরেই।

এক কর্মদিবসের দুপুরবেলায় সেখানে গিয়ে দেখা গেল শিশুরা মধ্যাহ্নভোজ শেষে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এখানে সরকার থেকেই বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা হয়।

মাসিক খরচ শিশুপ্রতি মোটে ৫০০ টাকা। ধারণ ক্ষমতা ৫০ জন।

যদিও সেদিন মোটে ৯টি শিশু এসেছে।

হলিফ্যামিলি হাসপাতালের অফিস সহকারী শারমীন আক্তার তার সন্তানকে এখানে রেখে অফিসে যান প্রতিদিন।

তিনি বলছিলেন, এই ডে-কেয়ারটিতে সন্তানকে রাখতে পারেন বলেই চাকরিটি করতে পারছেন তিনি।

জানা যাচ্ছে ,সরকারী ৪৩টি ডে কেয়ার সেন্টারের মোট ধারণ ক্ষমতা ২৮শ’র কিছু বেশী।

আরো কুড়িটি ডে-কেয়ার রয়েছে পাইপলাইনে।

এগুলোর ধারণ ক্ষমতা হবে ৬শ।

মহিলা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক সাহিন আহমেদ চৌধুরী বলছেন, এতদিন পর্যন্ত সরকারী ডে কেয়ার সেন্টারগুলো শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য ছিল। এখন উচ্চবিত্তদের জন্য ব্যয়বহুল ডে-কেয়ার সেন্টার নির্মাণের দিকেও মনযোগী হয়েছেন তারা।

সরকারী অফিসে ডে-কেয়ার নেই:

বাংলাদেশে গত দুই দশকে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ।

দেশের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করছে লক্ষ লক্ষ নারী।

সেখানে ঢাকার অভিজাত এলাকার হাতে গোনা বেসরকারী ডে কেয়ার কিংবা সারা বাংলাদেশের জন্য সরকারী উদ্যোগের তিন কিংবা সাড়ে তিন হাজার আসন কতটুকু পর্যাপ্ত?

ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা শিশু এবং মায়েদের নানা অধিকার নিয়ে কাজ করে।

সংস্থাটির পরিচালক খুরশীদ জাহান বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছে প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠানে ডে কেয়ার সেন্টার নির্মাণের।

কিন্তু বাস্তবতা হল বেশীরভাগ সরকারী অফিসেই ডে-কেয়ার সেন্টার নেই।

যেমনটি নেই প্রথমেই যে সরকারী চাকুরে উর্মী দে’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার অফিসে।

তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানাগুলোর একটি বড় অংশেরই ডে-কেয়ার নেই।

হাতে গোনা কয়েকটি কমপ্লায়েন্স কারখানায় আছে। এটা তাদের কমপ্লায়েন্স হবার একটি শর্তও বটে।

আর রয়েছে, কয়েকটি বহুজাতিক এবং স্থানীয় কিছু নামকরা প্রতিষ্ঠানে।

এরকম একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন সেবাদাতা কোম্পানি গ্রামীণ ফোন।

স্টেট অব দ্য আর্ট:

ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জিপি হাউজ নামে পরিচিত গ্রামীণ ফোনের প্রধান কার্যালয়টি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন একটি ভবন।

এই ভবনটিতেই রয়েছে সুপরিসর একটি ডে কেয়ার সেন্টার।

গ্রামীণ ফোনের একজন মহাব্যবস্থাপক মুন্নী মারুফা আমাকে ডে-কেয়ার সেন্টারটি ঘুরিয়ে দেখান।

যাকে বলে স্টেট অব দ্য আর্ট। মিজ মারুফা বলছিলেন, এখানে কার্যক্রম শুরু করার সময় থেকেই ডে কেয়ার সেন্টারটি চালু রয়েছে।

দুপুরবেলায় এই ডে-কেয়ার সেন্টারে গিয়ে দেখা গেল, অনেকগুলো শিশু। গমগম করছে যেন।

কিছুক্ষণ পর আশপাশের স্কুলগুলো ছুটি হলে নাকি আরো শিশু আসবে।

জানা যাচ্ছে ঢাকার বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক, ব্র্যাক ব্যাংক, টেলিকম প্রতিষ্ঠান রবি ও বাংলা লিংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানেরও এমন আধুনিক মানের ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকেরও রয়েছে একটি ডে-কেয়ার সেন্টার। সচিবালয়েও একটি পূর্ণাঙ্গ ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে।

এটি অবশ্য পরিচালনা করে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।

‘চাকরিটা ছাড়তে হত’:

সাজিয়া খান গত ছ’ বছর ধরে চাকরি করছেন গ্রামীণ ফোনে।

সবেমাত্রই তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ করে অফিসে এসে যোগ দিয়েছেন।

অফিসের ডে-কেয়ারেই রয়েছে তার শিশুটি।

নিশ্চিন্তে তিনি অফিসের কাজ করছেন।

মাঝে মাঝে এসে সন্তানকে দিয়ে যাচ্ছেন বুকের দুধ।

বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলছিলেন, “অফিসে ডে-কেয়ারটি আছে বলেই চাকরিটা নিশ্চিন্তে করতে পারছি। নইলে বাইরে ডে-কেয়ার খুঁজতে হত। না পেলে চাকরিটা ছাড়তে হত”।

কিন্তু মিসেস খানের মত ভাগ্যবান বাংলাদেশের খুব কম চাকুরীজীবীই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেয়া স্বত্বেও বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানই এখনো ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরিতে গড়িমসি করছে বলে জানাচ্ছেন ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের খুরশীদ জাহান।

বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনকে তারা প্রতিনিয়ত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন এজন্য। তবে অগ্রগতি খুব একটা নেই।

এমনকি মিসেস জাহান বলছেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

এদিকে, বেসরকারী উদ্যোগে যেসব ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠছে তাদের জন্যও নেই কোন আইন কিংবা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান।

তাই সেগুলো নিয়েও মায়েদের মধ্যে একধরণের উদ্বেগ রয়েছে।

মহিলা অধিদপ্তর অবশ্য বলছে এ বিষয়ক একটি আইনের খসড়ার কাজ এখন চলছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা