সকালের আতঙ্ক কাটল বিকেলের বিশ্বরেকর্ডে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ 

মূল প্রেস বক্সে সংস্কারকাজ চলছে। তাই সাংবাদিকদের জন্য বসার ব্যবস্থা হয়েছে করপোরেট বক্সে, ওয়ার্ক স্টেশনের চেয়ে যার পরিবেশ বিশেষ সুবিধাভোগী দর্শকদের জন্য বেশি উপযোগী। উপভোগ্য তো বটেই। অবশ্য গতকাল শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে শুরু হওয়া বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনটা তাড়িয়ে উপভোগ করার মতোই কেটেছে।

২৪ রানে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশ আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই দিন শেষ করেছে। দুর্দান্ত এই প্রত্যাবর্তনের গল্পের পরতে পরতে রোমাঞ্চ মিশে। তবে এই রোমাঞ্চে মারকাটারি মেজাজের ঝাঁজ নেই, আছে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর স্নায়ুক্ষয়ী লড়াই।

 

kalerkanthoমুশফিকুর রহিম ও লিটন কুমার দাসের মধ্যকার অবিচ্ছিন্ন ২৫৩ রানের ষষ্ঠ উইকেট জুটি যেন টেস্ট ক্রিকেটেরও জয়গান। যেটি জুটি আবার একটি বিশ্ব রেকর্ডের মালিক বানিয়ে দিয়েছে এই দুই ব্যাটারকে। এর আগে ২৫ রানের কমে ৫ উইকেট হারানো কোনো দলের টেস্টে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে যেখানে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপই ছিল না কোনো, সেখানে কিনা কাল এই জুটি ডাবল সেঞ্চুরি পেরিয়ে ট্রিপলের পথে!

বেসরকারি সফরে এসে বিপুল সমাদৃত হয়েছেন আইসিসির চেয়ারম্যান। কিন্তু মান্যবর অতিথির জন্য আয়োজিত বিসিবির যাবতীয় শোডাউন বিফলে যেতে বসেছিল মিরপুর টেস্টের প্রথম ঘণ্টায়। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ৪৩ রানের বিপর্যয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫৩ ও ৮০ রানে গুটিয়ে যাওয়ার তাজা স্মৃতি যে গতকাল ফিরে এসেছিল মিরপুরে। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ ৬.৫ ওভারেই খুইয়ে বসে পাঁচ ব্যাটারকে। একুশ শতকে সবচেয়ে কম সময়ে ইনিংসের অর্ধেকটা হারিয়ে ফেলার এটা দ্বিতীয় ঘটনা। তখন মনে হচ্ছিল ৪৩-ও অসম্ভব নয়, কিংবা ৫৩, নিদেনপক্ষে ৮০ রানের লজ্জা নতুন হয়তো সঙ্গী হতে যাচ্ছে!

চট্টগ্রামের সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর রহিম ক্রিজে আছেন তো কী? পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে সাকিব আল হাসানের তিরোধানে ধীরপায়ে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসা লিটন দাস যতই ফর্মে থাকুন না কেন, এই ধাক্কা কি সামাল দিতে পারবেন? অতীত জানাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে ষষ্ঠ উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি ২০ রানের। তাই টেস্টের পূর্বাভাস শুরু হয়ে যায় ম্যাচের আয়ু ঘণ্টার কাঁটা না ছুঁতেই! বড়জোর তিন দিন, ব্রডকাস্টারের মাথায় হাত। ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিশালী বোমার সলতেয় আগুন দেওয়া হয়ে গেছে, শুধু বিস্ফোরণটা বাকি।

অ্যাকশন মুভির এমন মুহূর্তে ভোজবাজির মতো নায়কের আবির্ভাব ঘটে, শেষ মুহূর্তে বোমা অকার্যকর করে দেন তিনি। মিরপুরে কাল একজন নয়, দুজন নায়ক পেয়েছে বাংলাদেশ—মুশফিক ও লিটন। সময় গড়িয়েছে আর তাঁরা ব্যাটিং বিপর্যয় ভুলিয়ে দিয়ে একসময় ম্যাচের রিমোট কন্ট্রোলটাই নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। টেস্টের এখনো সাড়ে তিন ইনিংস বাকি। তবু মুশফিক-লিটনের ব্যাটেই ম্যাচের ভাগ্য পড়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের কোচ রাসেল ডমিঙ্গো কিংবা শ্রীলঙ্কার ক্রিস সিলভারউড—প্রথম দিনের পর দুজনের বক্তব্যের সারসংক্ষেপটা এমনই। এই জুটি যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, ততই ম্যাচ ঝুঁকবে বাংলাদেশের দিকে। অন্যদিকে এই জুটি ভেঙে প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় লঙ্কানরা।

তবে দলীয় হিসাব-নিকাশের সবটাই যেন মুশফিক ও লিটনের ব্যাটে লেখা। বীরোচিত ব্যাটিংয়ের গল্প বাংলাদেশের ক্রিকেটেও টুকটাক আছে। খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েসের রেকর্ড উদ্বোধনী জুটি বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। সেই প্রত্যাবর্তন ছিল দুর্ধর্ষ প্রতিআক্রমণের। আর মিরপুরের প্রত্যাবর্তন চুরমার হয়ে যাওয়া প্রাসাদের ইট-পলেস্তারা খুঁজে পেতে জোড়া দিয়ে স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধই, যা অনুপ্রেরণা জোগাবে অনাদিকালের কোনো দুর্দিনে।

তাঁরা জুটি বাঁধার পর মনে হচ্ছিল আচমকাই বদলে গেছে মিরপুরের উইকেট, উল্লসিত শ্রীলঙ্কার বোলিং ইউনিটও কেমন হতোদ্যম। ভোজবাজির মতো দৃশ্যপট পরিবর্তনে হতবিহ্বল সফরকারী দলের অধিনায়ক দিমুথ করুনারত্নেও চার পা দৌড়ে বল করেছেন। কিন্তু মুশফিক তো বটেই, লিটনের মনঃসংযোগেও চিড় ধরাতে পারেনি তাঁর খণ্ডকালীন স্লো মিডিয়াম পেস।

মুশফিক বরাবরই টেস্ট ক্রিকেটের মনোযোগী ছাত্র। রক্ত পানি করা শ্রমে রান কেনেন তিনি। নিজের উইকেটের বিনিময়ে কত কী যে বিসর্জন দিতে পারেন মুশফিক। অন্যদিকে লিটন বরাবরের বিলাসী, তাঁর অনায়াস ব্যাটিং গনগনে সূর্যের নিচে বসা সাধারণ গ্যালারির দর্শকদেরও করপোরেট বক্সে বসার সুখানুভূতি দেয়। সেই লিটন আবার অনিবার্য কিছু রান ফেলেও আসেন অবহেলায়। গতকালই যেমন আউট হতে বসেছিলেন ব্যক্তিগত ৪৭ রানে। আসিথা ফার্নান্ডো বাউন্সারের টোপ দিয়েছিলেন। সেটি হুক করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছিলেন লিটন, যা তালুবন্দি করতে পারেননি বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কুশল মেন্ডিসের বদলি ফিল্ডার কামিন্দু মেন্ডিস। দিনের শেষে এই ভুলেরই চড়া মাসুল গোনার আক্ষেপ ঝরেছে লঙ্কান কোচ সিলভারউডের কণ্ঠে।

ওই একটিই। দিনের খেলার ৪৫ মিনিটের বাকি সময়টুকুতে আর কোনো ভুল করেননি মুশফিক ও লিটন। বাড়তি সময় পাওয়া যেকোনো ব্যাটারের ঐশ্বর্য। এই বাড়তি সময় কাজে লাগিয়ে বোলারদের শাসন করেন লিটন। মিড অফ ছাড়া মাঠের চারধারে রান করেছেন তিনি। সবচেয়ে বেশি মিড উইকেটে, পুল শটে। তবে সবচেয়ে আকর্ষক ছিল লিটনের ঝুঁকিহীন ব্যাটিং। সম্ভাবনা জাগানো তাঁর কত ইনিংসেরই তো অপমৃত্যু হয়েছে বেখেয়ালি শটে। গতকাল ষাটের ওপরে স্ট্রাইক রেটে রান তুললেও ফলস শটের মাত্রা কমিয়ে ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন লিটন।

ব্যাটিংয়ে সঙ্গীর প্রভাব থাকে। লিটনের ঝুঁকিহীন ব্যাটিংয়ে মুশফিকের ঋষিতুল্য স্থিরতার প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে। ন্যূনতম ঝুঁকিও নেননি তিনি। ইটের ওপর ইটে সাজিয়েছেন নিজের নবম সেঞ্চুরি। আর দুই সেঞ্চুরিয়ানের ব্যাটে স্কোরবোর্ডে ঝকঝকে দেখাচ্ছে বাংলাদেশকে।

অথচ দিনের প্রথম ঘণ্টায় কী ঝড়টাই না গেছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। দুই ওপেনার ফিরে গেছেন কোনো রান না করে। চট্টগ্রামে ‘কনকাশন সাব’ হয়ে ভড়কে দেওয়া কাসুন রাজিথার সঙ্গে আসিথা ফার্নান্ডো সকালের উইকেটের সুবিধাকে কাজে লাগিয়েছে, তাতে হাড়গোড় বেরিয়ে পড়েছে মমিনুল হকদের। আউট হওয়া পাঁচ ব্যাটারের কেউই দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি, তিনজন রানহীন। এই বিপর্যয়ের জন্য ন্যূনতম দায় নেই মিরপুরের উইকেটের। বড়জোর প্রশংসা পেতে পারেন সফরকারী দলের দুই পেসার, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সকালের উইকেটের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য। আউট হওয়া বাংলাদেশি ব্যাটারদের মূল্যায়ন অবান্তর, মুশফিক-লিটনের উচ্চাঙ্গের ব্যাটিং উপভোগ করার দিনে আর সব অপ্রয়োজনীয়!

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ