শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে যা করা দরকার

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

গত বছর পিপল্স লিজিং নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়িত হওয়ার ফলে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থায় চিড় ধরেছে বলে আমরা লক্ষ করেছি। আর এ আস্থাহীনতার কারণে এরই মধ্যে অন্যান্য নন-ব্যাংকিং সংস্থাগুলো, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসা করতেন, তাদের ব্যাংকগুলো আর ঋণ দিচ্ছে না।

অর্থাৎ সব ব্যাংকই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, নন-ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউটগুলোকে আর ঋণ দেবে না এবং তাদের কাছে আগের যে ঋণ রয়ে গেছে, সেগুলো ফেরত দেয়ার জন্য চাপ দেবে। এতে করে অর্থনীতির একটি বড় অংশ ভীষণ চাপের মুখে রয়েছে এবং আমরা খুব শঙ্কিত যে, বর্তমান অর্থবছরে আরও কয়েকটি নতুন সংস্থা অবসায়িত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেটি হলে শুধু নন-ব্যাংকিং সেক্টরের জন্যই নয়, গোটা ব্যাংকিং সেক্টরের জন্যও আঘাত হিসেবে বিবেচিত হবে।

আমরা বিগত বছরগুলোতে দেখে এসেছি, সরকার যে পরিমাণ টাকা ট্যাক্স হিসেবে আদায় করে তা দিয়ে সরকারের পুরো খরচ চলে না। অনেক আগে বাজেটের ঘাটতি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে মেটানো হতো। বর্তমানে আমরা সেটা থেকে সরে আসতে পেরেছি।

অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি মেটাতে এখন আর বৈদেশিক ঋণ আমাদের খুব একটা নেয়া লাগে না; কিন্তু অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়া লাগে। গত কয়েক বছরে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে একটি বড় অঙ্ক ঋণ হিসেবে নিয়েছে। আরেকটি অংশ অবশ্য ব্যাংক থেকেও নিয়ে থাকে।

কিন্তু আমরা বছর শেষ হওয়ার আগেই খবর পেলাম, এ অর্থবছরে যত টাকা ব্যাংক থেকে নেয়ার কথা ছিল তার পুরোটাই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকার ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃসংবাদ। কারণ বর্তমান অর্থবছরের আরও প্রায় ৬টি মাস পড়ে আছে। এ সময় সরকার যদি আরও ঋণ নেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে ব্যবসায়ীদের তো আর ঋণ দেয়ার টাকা থাকবে না।

অর্থাৎ ব্যক্তি খাতে যেসব শিল্পগোষ্ঠী এবং বাণিজ্যগোষ্ঠী রয়েছে, এদের আর ব্যাংক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ দেয়া সম্ভব হবে না। যার ফলে শিল্প প্রবৃদ্ধি কমে যাবে, ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি কমে যাবে এবং দুর্বল খাত যেগুলো রয়েছে যেমন কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে আঘাত আসতে পারে। তাতে করে বাংলাদেশের আরেকটি বড় রকমের বাণিজ্য সংকট, শিল্প সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ২০১৯ সালে আমদানি কমে গেছে। অবশ্য সেটার জন্য অতটা উদ্বিগ্ন নই। কিন্তু উদ্বিগ্ন হচ্ছি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ার কারণে। কেননা যন্ত্রপাতি আসে শিল্প খাতের জন্য। যন্ত্রপাতি যখন আসছে না, তখন ধরে নেয়া যায় শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটছে না।

আরও জানতে পেরেছি, কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে। কাঁচামাল আসে পুরনো শিল্পে ব্যবহারের জন্য। আর কাঁচামাল আমদানি না হলে পুরনো শিল্পগুলো সংকুচিত হয়ে পড়বে। কাজেই আমদানি কমে যাওয়ায় যতটা শঙ্কিত, তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত আমাদের ভেতরের শিল্প ও বাণিজ্যের মধ্যে যে সংকোচন আসছে, তার জন্য।

এরই মধ্যে বিজিএমই’র সভাপতি বক্তব্য রেখেছেন, পোশাক শিল্প কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। তাদের সরকার যদি আরও বেশি সাহায্য-সহযোগিতা না দেয়, তাহলে তাদের চলার পথ অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। এখন পর্যন্ত আমরা পোশাক শিল্পের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল রয়েছি। মনে হচ্ছে, সরকারকে ক্ষতি স্বীকার করেও হয়তো এ শিল্পকে আরও সাহায্য করতে হবে।

আমাদের অর্থনৈতিক খাতের মধ্যে একটি বড় খাত হচ্ছে স্টক মার্কেট। বিদেশে শিল্প স্থাপন হয় স্টক মার্কেট থেকে ঋণ নিয়ে, ব্যাংক থেকে নয়। এর কারণটি হল ব্যাংক আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে থাকে চাহিবামাত্র আমানতকারীকে ফেরত দেয়ার শর্তসাপেক্ষে।

চলতি আমানত যখন চাইবে ফেরত দিতে হবে, এবং সেভিংসের আমানতও অনেকটা তা-ই। কিন্তু শিল্প ঋণের যে প্রকল্প ঋণ, সেটি কিন্তু ১০ বছরের নিচে দিলে পোষায় না। কারণ এটি একটা লং টার্মের বিষয়। এখন ১০-১২ বা ১৫ বছর মেয়াদি ঋণ যদি আমরা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে দেই, তাহলে এখানে ডিপোজিটের সঙ্গে লোনের একটা মিস-ম্যাচ হবে। আগেও হয়েছে, এখনও মাঝে মধ্যে হচ্ছে। সেজন্য এটাকে স্টক মার্কেটে নিয়ে যাওয়া দরকার।

কিন্তু গত বছরের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত স্টক মার্কেটের যে অসুস্থতা আমরা দেখছি, সেখান থেকে ঋণ নেয়া খুব একটা আশাপ্রদ হবে না। কেননা ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে যাচ্ছে না। তাছাড়া গত দু’বছরে যতগুলো নতুন কোম্পানি স্টক মার্কেটে গিয়েছে, সব কোম্পানি ধ্বংস হয়ে গেছে।

দেখা গেছে, অনেক কোম্পানি ১০ টাকার শেয়ার মূল্য নিয়ে বাজারে ঢুকে লসের কারণে সেই শেয়ারের দাম ৩ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে তো চলতে পারে না। অনেকে অভিযোগ করে বলেন, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মধ্যে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে; তারা মিলেমিশে জনগণের রক্ত চুষে খাচ্ছে।

ব্যাপারটা এ রকম যে, ছোট ছোট দুর্বল কোম্পানিকে বলির পাঁঠা হিসেবে মার্কেটে আনা হয় এবং তাদের মাধ্যমেই জনগণকে আকৃষ্ট করে যে পরিমাণ টাকা আসে, তার প্রায় পুরোটাই তারা খেয়ে-দেয়ে নষ্ট করে দেয়। এর থেকে বের হতে না পারলে শেয়ারবাজারে আস্থাহীনতার সংকট দেখা দেবে।

স্টক মার্কেটে ছোট-বড় মাঝারি কোনোরকম বিনিয়োগকারীরই এখন আর আস্থা নেই। চলতি বছর এটি একটি মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। কারণ ব্যাংক থেকে সরকারের অধিক ঋণ নেয়ার ফলে নতুন শিল্পপতিদের ঋণ দেয়া ব্যাংকের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন নতুন শিল্পপতিরা যদি স্টক এক্সচেঞ্জেও যেতে না পারেন, তাহলে নতুন শিল্পের প্রসার বন্ধ হয়ে যাবে।

সুতরাং স্টক এক্সচেঞ্জকে গতিশীল করা প্রয়োজন। এর জন্য কী করতে হবে এর জবাবে আমরা এভাবে বলতে পারি যে, যেহেতু সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ফেল করেছে বলা যায় এবং তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও হয়েছে। এছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল, এর চেয়ারম্যানের তৃতীয়বার নির্বাচিত হওয়া। আইন অনুযায়ী সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান পরপর দু’বারের জন্য নির্বাচিত হতে পারেন; কিন্তু তিনি আইন ভঙ্গ করে তৃতীয়বারের মতো অ্যাপয়নমেন্ট নিয়েছেন।

তিনি হয়তো বলতে পারেন তাকে অ্যাপয়নমেন্ট দিলে তার কী করার আছে? এটা তো খোঁড়া যুক্তি। কেউ না চাইলে কেউ কি দেয়? নিশ্চয়ই দেয় না, তিনি তদবির করে হয়েছেন। এতে করে জনগণের আস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। বর্তমান এসইসি থাকতে মানুষ আর স্টক মার্কেটে ফিরবে বলে মনে হয় না। সুতরাং অতি শিগগিরই এ এসইসিকে পরিবর্তন করতে হবে। একেবারে খোলনলচেসহ সব পরিবর্তন করে এমন একজন এসইসি চেয়ারম্যান আনতে হবে যিনি সৎ, দক্ষ ও শক্ত।

শক্ত কথাটির ওপর জোর দিচ্ছি এজন্য যে, এর আগে বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে পারি, যারা চেয়ারম্যান থাকাকালে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে স্টক এক্সচেঞ্জ চলেছে। এর মধ্যে মির্জ্জা আজিজুুুল ইসলামের কথা বলতে পারি। তাহলে দেখা যায়, সৎ ও শক্ত লোককে দিলে সবকিছু ঠিকমতোই চলে। তখন এ ব্যবসায়ীদের দিয়েই কাজ চলে। কিন্তু এখানে যখন সন্দেহজনক কাউকে দেখি, তখন আস্থাহীনতার কারণে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়।

কারণ স্টক মার্কেট এমন একটি মার্কেট, যেখানে আস্থাই হল বড়। আস্থার সংকট হলে সেটা নিয়ে সামনে এগোনো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। অনেকে বলছেন, ১০ হাজার কোটি টাকা নাকি মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হয়েছে মার্কেটটাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য। এটি তো একটা হাস্যকর ব্যাপার। কারণ এখানে তো টাকার সংকট নেই, সংকট আস্থার। আস্থা ফিরে এলে জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কুল পাবে না। যেমনটি আগেও হয়েছে। তাই আস্থার সংকট টাকা দিয়ে মেটানো যাবে না।

সুতরাং সেখানে আস্থাই ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই আমরা বলব, সরকারের টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকা যেন আর এভাবে না দেয়া হয়। বরং আস্থা সৃষ্টি করার জন্য এসইসি পুনর্গঠনসহ আরেকটি ব্যাপারে নজর দিতে হবে, সেটা হল ডি-মিউচুয়ালাইজেশন। ইতিপূর্বে ডি-মিউচুয়ালাইজেশন হয়েছিল কিন্তু ভ্রান্তভাবে। ডি-মিউচুয়ালাইজেশনের অর্থ হল স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদ অর্থাৎ যারা এটাকে পরিচালনা করবেন, তাদের মধ্যে কোনো ব্যবসায়ী থাকবে না। সেটা হতে হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ লোকদের দ্বারা।

যেমনটি ভারতে আছে, আর পাশ্চাত্য দেশে তো আছেই। সাবেক অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিতের সময় ডি-মিউচুয়ালাইজেশন হল; কিন্তু সেখানে বলা হল, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জন থাকবেন নিরপেক্ষ। অর্র্র্থাৎ তাদের কোনো স্বার্থ থাকবে না, তারা কোনো ক্রয়-বিক্রয় করবেন না। আর যারা ক্রয়-বিক্রয় করবেন তাদের মধ্যে বোর্ডে থাকবেন ৪ জন।

এখন ঘটনা যা ঘটেছে, তা হল ওই ৬ জন নিরপেক্ষ লোক তারা ওই ৪ জনের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। কারণ হল ওই ৬ জনের তো কোনো শক্তি নেই, রিস্ক নেই, স্টেকও নেই, ফলে তারা সকালে অফিসে আসেন, দুপুরে লাঞ্চ করেন, বিকালে চলে যান। ওই ৪ জন ২৪ ঘণ্টা বসে প্রভাবিত করেন এবং মার্কেট চালান। এটি ভ্রান্তভাবে করা হয়েছে বলেই এমনটা হয়েছে। ওই ৪ জনের বোর্ডে বসার কথা নয়।

এ সরকারের কাছে প্রত্যাশা, তাত্ত্বিকভাবে হলেও পুরোপুরি ডি-মিউচুয়ালাইজেশন করা হোক এবং বোর্ডে যেন কোনো প্লেয়ার না থাকে সে ব্যবস্থা করা হোক। ১০ জনের মধ্যে যে ৪ জন রয়েছেন, তাদের প্রত্যাহার করে নিতে হবে। বোর্ডের ১০০ জনই থাকবেন নিরপেক্ষ লোক। এসইসি ও ডি-মিউচুয়ালাইজেশন পুনর্গঠন করে একটা পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং এটি খুবই জরুরি।

ব্যালেন্স অব পেমেন্টে উন্নতি করতে হলে আমাদের এক্সপোর্ট বাড়াতে হবে। আর এক্সপোর্ট বাড়াতে হলে আমাদের পোশাক খাতসহ আইটি সেক্টর, চামড়া সেক্টর- এগুলোকেও উৎসাহ দিয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে। তা হলে ধীরে ধীরে আমাদের এক্সপোর্ট বাড়বে। আর এক্সপোর্ট বাড়লে আমাদের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।

বৈদেশিক রেমিটেন্স ভালো অবস্থানে আছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে। কোনোভাবেই যেন বাইরের রেমিটেন্স পড়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কারণ আমাদের পদ্মা সেতুসহ অনেক বড় বড় প্রকল্পে প্রচুর টাকা লগ্নি করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছিল কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের রক্ত দেয়ার মাধ্যমে। আজকেও যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখব, সবচেয়ে ভালো খাত হল বাইরে যারা রয়েছেন, আমাদের শ্রমিক, তাদের পাঠানো টাকা। গরিবের ঘাম শুকানো টাকা দিয়ে আমরা চলছি। বড়লোকের টাকায় চলছি না; কিন্তু সরকার ব্যাংক পরিচালনাসহ স্টক মার্কেট নীতিনির্ধারণীতে সম্পূর্ণ দুষ্ট ধনীদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়।

সুতরাং বর্তমান সরকার দুষ্ট ধনীচক্রের কাছ থেকে বের হয়ে এসে জনগণের সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, আমাদের এমনটাই আশা। এটি করতে পারলে দেশ ও জাতির জন্য ২০২০ সালটি হবে একটি ভালো বছর। আমরা সেই প্রত্যাশায় রইলাম।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর