“শেষ ইচ্ছা ছিল ক্যাম্পাসে একটা ভালো মানের ক্যান্টিন করা”

সুব্রত গাইন, রাবি:
মুক্তিযুদ্ধকালীন কিংবা তার আগে থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পরিচিত নাম আবু আহমেদ। ক্যাম্পাসে সবার কাছে আবু ভাই নামেই পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি সত্তর , আশি, নব্বই ও একুশ শতকের আন্দোলনের স্বাক্ষী হয়ে আছেন। চোখের সামনে দেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা আন্দোলনের উত্থান ও পতন। সারাদিন প্রাণ প্রিয় ক্যাম্পাসে সময় কাটিয়েছন উৎসাহ, উদ্দীপনা আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভালবাসায়। তার যেন ভালবাসার কমতি ছিল না। সবার কাছে হয়ে উঠেছিল আড্ডার অন্যতম ব্যক্তিত্ব।

তবে শুধুমাত্র আড্ডাই নয় সকল প্রকার রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা ও পরিকল্পনার মূল কেন্দ্র ছিল আবুর ক্যান্টিন। তিনি শুধু ক্যান্টিন বা খাবারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন না। একজন উদার মানুষও ছিলেন। শিক্ষার্থীদের সহয়তা করেছেন নানাভাবে। এমনকি ভতিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য করেছেন থাকার ব্যবস্থা।

একসময় শত মানুষ ও শিক্ষার্থীকে সহায়তা করা আবু ভাই আজ একটু সহায়তার অভাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন সেই খোঁজ খবর আমরা কেউ রাখি না। এখন আর ভালো নেই সেই আবু ভাই। বয়স ইতিমধ্যে ৭৫ পেরিয়েছে। টানা ১৪ দিন হাসপাতালে থাকার পর বাসায় আছেন তিনি। নানা রোগ বাসা বেধেছে তার শরীরে। নিজে উপার্জন করার শক্তিটুকুও হারিয়েছেন।

একসময়ের প্রাণচঞ্চল এই মানুষটি এখন ডায়াবেটিস, এ্যাজমা, কিডনি, হাইপ্রেসার, লিভার, হাটুর জয়েন্টসহ নানা সমস্যায় ভূগছেন। মুখ ফুটে কথা বলতে গেলেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। খুব কষ্ট করে বললেন ‘ শেষ ইচ্ছা ছিল ক্যাম্পাসে একটা ভালো মানের ক্যান্টিন দিবো’ তার আর বুঝি হলো না।

তাঁর পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহ আমাকে একটু সুস্থ করলেই আবারও ক্যান্টিন দিবো।

তিনি আবেগময় কণ্ঠে বলা শুরু করলেন তার ক্যাম্পাসে আবু ভাই হয়ে উঠার গল্প।

তিনি বললেন,‘ ১৯৬৩ সালে তিনি ক্যাম্পাসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতাম। তখন শ্রমিকসহ অন্যান্যদের খাওয়া দাওয়ার জন্য একটা খাবারের দোকানের দরকার ছিল। তখনকার মিলিটারি সায়েন্স ভবনের সামনে ভিসি সাহেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন আবু ক্যান্টিন দিবা না শ্রমিক হিসেবে কাজ করবা। কিন্তু সুযোগ পাওয়ার সত্ত্বেও করতে পারিনি।’ তৎকালীন মীর ওবাইদুল রহমান স্যারের সহযোগিতায় স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে তিনি ‘আবু ক্যান্টিন’ খোলেন। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পানির ট্যাঙ্কির নিচে ছিল তার সেই স্বপ্নের ক্যান্টিনটি। মাঝে ৪ বছর বিভিন্ন কারণে বন্ধ থাকার পর দোকানটি পুণরায় স্থাপন করেন বর্তমান শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার টিএসসিসির পূর্ব পাশে। এরপর থেকে তার দোকানের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বেড়েছে। দীর্ঘদিন চালানোর পর শারিরীক অসুস্থতার কারণে ২০০৭ সালের দিকে বন্ধ করে দেন দোকান। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে বর্তমান ১ম ও ৪র্থ বিজ্ঞান ভবনের মাঝখানের জায়গাতে আবারো ক্যান্টিন খোলেন আবু আহমেদ। তবে অসুস্থতার কারণে এক বছর আগে আবারো বন্ধ হয়ে যায় তার ক্যান্টিন। এখনো বন্ধই রয়েছে। আর সাথে বন্ধ হয়ে গেছে তার আয়ের রাস্তা।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে , চার বছর আগে পায়ের অপারেশন করান আবু আহমেদ। এরপর থেকেই শরীরে বাসা বাঁধতে থাকে নানা রোগ। বর্তমানে ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যার পাশাপাশি তার দুইটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। টানা ১৪ দিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাটিয়ে গত ২০ এপ্রিল বাসায় ফিরেছেন। শুধু বিছানায় পড়ে আছেন। তবে আগের চাইতে এখন তার অবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। জীবনের বাকিটা সময় কি হবে তা আল্লাহ ভাল জানেন। তাছাড়া পরিবারে তিন ছেলে থাকা সত্ত্বেও সবাই আলাদা থাকেন। দুই মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকার ঔষধ প্রয়োজন হয় আবু আহমেদের। যা পরিবারের পক্ষে বহন করা কঠিন।

তবে তার পরিবারের আক্ষেপ, আবু ভাইয়ের সাথে এতোদিনের কত বড় বড় লোকের ওঠাবসা অথচ তার ছেলেদের মধ্যে কেউ একটা কেরাণির চাকরিও পায়নি। তার ৩ ছেলে, ২ মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলের টাকায় চিকিৎসার সব খরচ চলছে। বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করাতে আবু ভাইকে। এতে অনেক টাকার দরকার আবু ভাইয়ের। শেষ সম্বল যে ৩ টি গাছ ছিল তাও বিক্রি করা হয়েছে। সেজন্য সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগীতা চেয়েছেন তার পরিবার। আবু আহমেদের ব্যক্তিগত নম্বর (০১৭২৩১৫৩৪৬০) বিকাশ করে পাঠানো যাবে সহযোগীতা।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী আবুর জন্য কিছু টাকা তুলে তার বাড়িতে দিয়ে আসেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, উনার অবস্থা দেখে চোখে জল চলে আসে। মনে হচ্ছে উনি বেঁচে থেকেই বেশি কষ্টে আছেন। কিছু খেতে পারছেন না, ঠিকমতো প্রসাব হয়না, চলাফেরাও করতে পারেন না। এর উপরে টাকা পয়সাও নেই যে চিকিৎসা করাবেন।

সাবেক শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই ক্যাম্পাসে ক্যান্টিন পরিচালনা করে আসছেন আবু আহমেদ। তিনি আমাদের একজন অভিবাবক হিসেবে কাজ করতেন। চোখের দিক তাকালেই বুঝতে পারতেন পকেটে টাকা আছে কি না ? টাকা পয়সা না থাকলেও তিনি আমাদের খাওয়াতেন। আমাদের নানা মুখী আবদার রক্ষা করতেন। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন একজন উদার মনের মানুষ যার ফলে শিক্ষার্থীদের মন বুঝতে তাঁর সময় লাগতো না।

স/অ