শুধু একটি গাড়িই যখন গণহত্যার অস্ত্র!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ফরাসি পর্যটন শহর নিসে বৃহস্পতিবার রাতে বাস্তিল দিবসের আতশবাজির অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলায় ৮৪ জনের প্রাণহানির ঘটনার আকস্মিকতা এবং বীভৎসতা সবাইকে হতবাক করেছে। প্রায় ১২ ঘণ্টা পরও কোনো গোষ্ঠী এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে, ফরাসি প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টতই বলেছেন যে এই হামলা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীদের যুদ্ধেরই অংশ। গত দেড় বছরের মধ্যে ফ্রান্সে এটি তৃতীয় বেপরোয়া প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলা। কিন্তু এই সাম্প্রতিক হামলার ধরন এবং মারণাস্ত্র হিসেবে ট্রাকের ব্যবহার সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের জন্য বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে।

 

 

নীতিনির্ধারক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হবে আপাতদৃশ্যে অস্ত্র হিসেবে মনে হয় না এ রকম আর কী কী সন্ত্রাস হামলার হাতিয়ারে রূপান্তরিত হতে পারে। বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে একটি সাধারণ ট্রাক ঘণ্টায় সত্তর থেকে আশি কিলোমিটার বেগে জনসমাবেশের ওপর প্রায় দুই কিলোমিটার যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তা অকল্পনীয়। ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, লোকজন ট্রাকটিকে থামানোর চেষ্টা করলে হামলাকারী চালক তার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশ সামনের দিক থেকে চালককে গুলি করে ট্রাকটিকে থামানোর আগেই শিশু-নারীসহ ৮৪ জন নিহত হন। কার্টুন সাময়িকী শার্লি এবদোর কার্যালয়ে হামলা এবং গত বছরের নভেম্বরে কনসার্ট হল ও স্টেডিয়ামের হামলাগুলোতে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিরা ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। কিন্তু নিসের এই হামলায় ট্রাকের ভেতরে কিছু অস্ত্র পাওয়া গেলেও মূল হামলা এবং গণহত্যা চালানো হয়েছে ১৯ টন পণ্যবহনে সক্ষম ট্রাক ব্যবহার করে।

 

 

এই হামলাটি পরিচালিত হয় ফ্রান্সের জাতীয় দিবসের উৎসবে। হামলার জন্য এই দিনটিকে বেছে নেওয়ায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ বলেছেন যে সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য হচ্ছে ফ্রান্সের মূল্যবোধকে আঘাত করা। ফ্রান্স অনেক দিন ধরেই সন্ত্রাসবাদীদের হামলার লক্ষ্য। বাস্তিল দিবসের হামলার বিষয়ে এখনো কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নাম উচ্চারিত না হলেও অনেকেই ইসলামিক স্টেট বা আইএসের আগের একটি বিবৃতির কথা স্মরণ করেছেন। ওই বিবৃতিতে ফ্রান্সে তাদের ভাষায় বিধর্মীদের লক্ষ্য করে যেখানে যেভাবে সম্ভব সেভাবে হামলা চালানোর জন্য তারা তাদের সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। বিবিসির এক সংবাদে বলা হয়েছে, এই হামলার পর টুইটারে আইএস সমর্থকদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এই হামলার পর প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ প্রথম যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা তিনি ইরাক ও সিরিয়ায় ফরাসি সামরিক ভূমিকা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন।

 

 

গত বছরের জানুয়ারিতে শার্লি এবদো কার্যালয় এবং একটি ইহুদি উপাসনালয়ে হামলার মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে সন্ত্রাসবাদের থাবা বিস্তৃত হয়। এরপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলাটি হয় নভেম্বরে। প্যারিসের কনসার্ট হল ও স্টেডিয়ামে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের সেই হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৩০ জন। এরপর দেশটিতে ছয় মাসের জন্য জারি করা হয় জরুরি অবস্থা, যার মেয়াদ পরে আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। ওই জরুরি অবস্থার মেয়াদ ২৬ জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিল এবং প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ জানিয়েছিলেন যে এবার আর তার মেয়াদ বাড়ানো হবে না। কিন্তু বৃহস্পতিবার গভীর রাতের ওই হামলার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এই জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। জরুরি অবস্থার আওতায় সীমান্তে কড়াকড়ি নজরদারি, বিমানবন্দর এবং জনসমাগমের স্থানগুলোতে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন ছাড়াও আদালতের পরোয়ানা ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো ও প্রতিবাদ সমাবেশ নিষিদ্ধের মতো ক্ষমতা সরকার প্রয়োগ করতে পারে। ইউরোপীয় ফুটবলের আসর আয়োজনের কারণে কয়েক মাস ধরে হাজার হাজার সশস্ত্র সেনাসদস্যকে কাজে লাগানো হয়। কিন্তু ইউরো ২০১৬ শেষ হওয়ার পর সপ্তাহ না পুরতেই এই নতুন হামলা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। সম্ভবত সে কারণেই প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ রিজার্ভিস্ট বা অবসরে যাওয়া সামরিক ও পুলিশ সদস্যদের কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।

 

 

নিসের হামলাকারীর পরিচয় সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে যতটুকু জানা গেছে, তাতে পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে ছিঁচকে চুরি এবং হিংসাত্মক হওয়ার অভিযোগ ছিল। কিন্তু সন্দেহজনক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে তাঁর সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত ৩১ বছর বয়সী ওই ট্রাকচালক এককভাবে এই হামলা চালিয়েছে, নাকি তার সঙ্গে আরও কেউ ছিল, তা এখনো স্পষ্ট নয়। হামলাকারী আপাতভাবে সাধারণ একটি মোটরযান ব্যবহার করে এককভাবে এত বড় যে হামলা চালাল, তা এখন শুধু ফ্রান্স নয়, অন্যান্য দেশের সবার জন্যও একটা বড় মাথাব্যথার কারণ হবে। এর আগে, গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, জঙ্গিরা গাড়িবোমা ব্যবহার করে বড় ধরনের নাশকতা করতে পারে। কিন্তু সেই গাড়ির ব্যবহার যে এভাবে হবে, তা তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না।

কামাল আহমেদ, সাংবাদিক

সূত্র: প্রথম আলো